মেছোপেত্নি ও দুটি তেচোখা মাছ
সুদীপ ঘোষাল
সুনীল বড় হয়েছে বন জঙ্গলের আদর পেয়ে । সুনীল জানে, মা মাঠের বাড়ির ফাঁকা জায়গায় গাছ লাগাতেন অবসর সময়ে। মায়ের সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ। মায়ের বাবার অফিসের মত ছুটি নেই। বিশ্রাম নেই। বৈকালিক ভ্রমণ নেই। বাবা অফিস থেকে এসেই জলখাবার খান। মা রান্নাঘরে। তারপর রাতের রান্নার ফাঁকে আমাকে পড়ানো।
সুনীল দেখে আর ভাবে, মায়ের কেন ছুটি নেই। মুখে হাসি নেই। বাবা পান থেকে চূন খসলেই ধমকের সুরে মাকে বকেন। মাঝে মাঝে গায়ে হাত তোলেন। বাবা বলেন, আমার পিঠে দুটো নয় তিনটে তেচোখা মাছের মত চোখ আছে। তুমি পাশের বাড়ি ভূতটার সঙ্গে প্রেম করো। আমি সব দেখতে পাই। সুনীল বাবার পিঠে চোখ দেখতে পায় না। মা ছাদে উঠলে ঘন একরাশ আলো মায়ের চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। ছাদ থেকে প্রতিবেশির সঙ্গে কথা বলে।
আজকে সুনীলের বাবা একটা চিঠি এনেছে। বিয়ের চিঠি। কলকাতার কাকুর মেয়ের বিয়ে। ঠিক হলো সুনীল আর বাবা যাবে। মা যাবে না। কারণ বাড়ি ফাঁকা থাকলে চোর আসে। সব কিছু চুরি করে।
সুনীল ভাবে, চোর মাকে চুরি করে নিয়ে যাবে না তো? আবার ভাবে বাবার সঙ্গে গেলে কলকাতা ঘোরা হবে। পড়া ফাঁকি দিয়ে মোবাইল ঘাঁটা হবে। তবু তার মায়ের জন্য মনখারাপ করে। কিন্তু একথা বলা যাবে না কাউকে।
তারপর আবোলতাবোল ছাইখেলার ছন্দে চলে এলো বিয়ের দিন। নকল পরিবেশে তিন চোখের রহস্যে সুনীলের মন একটু বিভ্রান্ত। বিয়েতে একটু আনন্দ হবে। পাঁচজনের মুখ দেখতে পাবে। এই মনে করে সে বাবার সঙ্গে চলে এলো কাকার মেয়ের বিয়েতে।
বিরাট অনুষ্ঠান। বড়লোক কাকার একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। শহরে এসে সুনীল বেশ খুশি। একদিন কলকাতা চিড়িয়াখানা দেখতে এলো বাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে। বাবাও আছে। সুনীল ঘুরে কত জন্তু জানোয়ার দেখলো। তারা কত কষ্টের মধ্যে আছে। বাঘগুলো খাঁচার কাছে এসে থমকে যাচ্ছে। পাখিগুলো বোধহয় ওড়া ভুলে গেছে। সব জন্তুগুলোর মুখ কেমন গম্ভীর। সুনীলকে তোতা পাখিটা বোধহয় একবার বলে উঠলো, ছেড়ে দে আমাদের। ফিরিয়ে দে আমাদের আকাশ। কিন্ত সুনীলের তো অত ক্ষমতা নেই। মানুষকে খুশি করতে গিয়ে ওরা আকাশ, অরণ্যকে বন্দি বানায়। এমন আহাম্মকি বুদ্ধি মানুষ ছাড়া আর কারও নেই। সুনীল নিজের মনে বিড়বিড় করে। ছোটো থেকে বাবা মায়ের ঝগড়া দেখে বড় হওয়া ছেলেটা এতবড় মন কোথা থেকে পেলো। সুনীল ভাবে, সে কি পাগল। কই চিড়িয়াখানায় কারও তিনটে চোখ তো দেখা গেলো না। তাহলে বাবা কেন প্রায়ই এই কথা বলে।
তারপর সন্ধ্যা হলে সকলে বিয়ে বাড়িতে ফিরে এলো সবাই। সুনীল ঘুরে বেড়ায় বাড়িময়। মায়ের মত মুখ খোঁজে। কাকিমার মেয়ে এসে বলে, এই সুনীল, এদিকে আয়। আমার কাছে বোস। কালকে আমার বিয়ে হয়ে যাবে। একটু কথা বলি তোর সঙ্গে। তোর কোন ক্লাস হোলো রে? আমি ভুলে গেছি।
সুনীল বলে, এবার ক্লাস এইট হবে।
— তাহলে তুই এত বোকা হাবার মত চুপ করে থাকিস কেন?
— আচ্ছা বলো তো দিদি, মানুষের তিন চোখ পিছনে হয়।
দিদি হেসে ওঠে। বলে, তুই এত বোকা কেন? এইটে পড়িস অথচ কি বোকা তুই। পিঠে কারও তিনচোখ হয় না। আর কাউকে জিজ্ঞেসও করবি না।
সুনীল কি করে বোঝায়, বাবার মুখ থেকে শোনা কথা কি করে মিথ্যা হয়। সে কিছু না বলে চুপ করে থাকে।
দিদি বলে, তুই আর ভাই মিলেমিশে থাকবি। তোরা দুইভাই আমার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাবি।
সুনীল বলে, যাবো।
সুনীল দেখে দিদির চোখে জল। দিদিকে ঠিক এখন মায়ের মত লাগছে। মায়ের চোখের জলও ঠিক এইরকম। সব মায়ের চোখের জল কি এইরকম হয়। হতেও পারে। মায়ের জাত তো।
একবার সুনীল গ্রামে বন্ধুর বাড়ি গেছিলো। সেখানেও সে তার মায়ের চোখে এইরকম জল টলটল করতে দেখেছিলো। চোখের জলের তো রঙ হয় না। তবু সুনীল একটা মিল খুঁজে পায়। আর কেউ পায় কি? সুনীল জানে না।
আজ বিয়ে। বাড়ি ভর্তি লোকজন। কে কোথায় শোবে সব ব্যবস্থা হচ্ছে। পাড়ার প্রতিবেশিদের ঘর নেওয়া হয়েছে। কাছাকাছি সব বাড়ি। বেশ ভালো লাগছে সুনীলের। বাবাকে বেশি দেখতে পাচ্ছে না সে। হয়ত কাজে ব্যস্ত আছে।
সুনীলও মোবাইল নিয়ে গেম খেলে মাঝে মাঝে। চিড়িয়াখানার ছবিগুলো দেখে। কাকার ছেলে সন্তুকে দেখায়। সন্তুর আবার অনেক বন্ধু। মেগাসিটির ছেলে। বেশিক্ষণ এক জায়গার থাকে না। সে স্মার্ট। কথাবার্তা সুন্দর। অনেক বন্ধু। ছেলে মেয়েরা তাকে ডেকে নিয়ে যায়। কিন্তু সুনীল একা একা থাকতেই ভালোবাসে।
বেশি মাথা তার পছন্দ নয়। ভিড় এড়িয়ে চলাই তার মজ্জাগত অভ্যাস। একজন বললো, কি রে হাবাগোবার মত বসে আছিস কেন? যা খেলা কর। আনন্দ কর। কিন্তু সুনীলের খেলতে এখন ভালো লাগছে না। খেতেও ভালো লাগছে না। মা হয়ত খেতেও পাচ্ছে না আমার কথা মনে করে। মায়ের তো আর কেউ নেই, আমি ছাড়া। আমি মায়ের কাছে যাবো। সুনীল চঞ্চল হয়ে উঠলো।
রাত হয়ে গেলো। বর যাত্রীর বাস চলে গেলো। তবু প্যান্ডেল ভরতি লোকজন। কিন্তু সুনিল বাবাকে দেখতে পায় না। বাবা কোথায় গেলো। এবার তো শুয়ে ঘুমোতে হবে। সকালে উঠেই বাড়ি যেতে হবে। আর ভালো লাগছে না মাকে ছেড়ে। মাকে ছেড়ে সুনীলের এই প্রথম থাকা। গুটি গুটি পায়ে সুনীল বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে গেলো রায়বাড়ি। এই বাড়িতে তাদের শোয়া খাওয়ার ব্যবস্থা। ঘর খোলা।অন্ধকার ঘর। তবু পাশের বাড়ির জানালা গলে এক চিলতে আলো পড়েছে ঘরের মেঝেতে। একটা আলোছায়ার মত ঘরের মায়াময় অবস্থা। সুনীল দেখলো দুটো মানুষ জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। পিঠগুলো আড়াআড়ি ভাবে আছে। ঠোঁটে ঠোঁট একবার লাগছে আবার খুলে যাচ্ছে। বাবাকে চিনতে পারা যাচ্ছে। আর ওটা কে? মাছ খাচ্ছে মনে হচ্ছে। এ নিশ্চয়ই মেছো পেত্নি। দুজনের কাপড় চোপড় এলোমেলো। বাবাকে ধরেছে, যাদু করেছে পেত্নিটা। পেত্নিটার বড় বড় মাথার চুল। দুধগুলো দুলছে বাতাবি লেবুর মত। সুনীল বাতাবি লেবু দেখেছে বাবুদের গোয়াল বাড়িতে।
দুজনের ঠোঁটে একটা করে, মোট দুটো তেচোখা মাছ। লালায় সাঁতার কাটছে। একবার এদিকে যাচ্ছে আর একবার ওদিকে। চুমু খাওয়ার সময় চোখ বন্ধ হয় কেন? সুনীল জানে না। ওদের দুজনের পিঠ দেখা যাচ্ছে না। তাহলে দেখা যেতো দুজনেরই কি পিঠে তিনটে চোখ?
সুনীল দেখছে মেছো পেত্নির গালের কষ বেয়ে বাবার দাবনার কাছে তিনচোখের মাঝখানে রক্ত পড়ছে টপ টপ করে। মোবাইল তার হাতে আছে। কিন্তু ছবি তুললেই ফ্ল্যাশ হবে। জেগে যাবে তিনচোখ। আর ভস্ম হয়ে যেতে পারে তার চোখ মুখ মন। তার থেকে এই মেছোপেত্নি তাড়াবার মন্ত্রটা বলি মনে মনে। মায়ের কাছে শোনা মন্ত্র।
‘খটাং খটাং খটাং, সাত ভুবনের জাহাজ খটাং। আসতে কাটে, যেতে কাটে, ছেদ কাটে, ভেদ কাটে। আমার বাবাকে যে করে হান, তার বুকে মারি শ্রীরামচন্দ্রের জলপড়া বাণ।’
সুনীল ভাবে, মাকে বাড়ি গিয়ে এই মেছো পেত্নি আর তিনচোখের কথা বলতেই হবে….