mobile website generator
লমাবম গোজেন্দ্র          
উপহার

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]



অনুবাদ গল্প   Home


[মণিপুরী থেকে অনুবাদঃ সদানন্দ সিংহ]

বিয়ে শেষ । রাত বেড়ে যাচ্ছে বলে হৈচৈ-কারীরা শান্ত হয়ে গেছে । বেশি বয়সের বিয়ে হলেও উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে উপযুক্ত পাত্রীর বিয়ে। এমন জাঁকজমকপূর্ণ এবং চোখ ধাঁধানো বিয়ে আর এদিকে হয়নি। ভবিষ্যতে হয়তো গল্প হয়ে থাকবে । পাত্র প্রফেসর মণিবাবু এবং পাত্রী ইবেতোম্বী দেবীর কোন খুঁত বের করা যায় নি । ইবেতোম্বী দেবী একজন বিদুষী মহিলা এবং চরিত্রে কলঙ্ক লেপন করা যায় এমন কোন কাণ্ড বা ঘটনা ইবেতোম্বীর নেই । পারিবারিক সম্বন্ধের মাধ্যমেই এই বিয়ে । শান্তশিষ্ট মণিবাবুর সঙ্গে বিয়ে হওয়াতে ইবেতোম্বী খুব খুশি এবং গর্বিত । এতোদিন একজন ভালোবাসার মানুষের অভাব ছিল, এবার তাও পূরণ হয়ে গেছে ইবেতোম্বীর ।
পাত্র-পাত্রীর বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজনদের দেওয়া উপহারে ঘরটা ভর্তি হয়ে গেছে । মণিবাবু একটু বাইরে গেছেন । ঘরে একা ইবেতোম্বী দেবী । ইবেতোম্বী ওর নরম আঙুলগুলি দিয়ে উপহারগুলি একটু টেনে বা ঠেলে ওর বন্ধুবান্ধবদের উপহারগুলি খুঁজতে থাকে । বন্ধুবান্ধবদের নাম লেখা অনেক উপহার একে একে দেখতে পায় সে । এরমধ্যে তার বান্ধবী অরুণিমা দিলজানের নাম লেখা একটা প্যাকেট সে দেখতে পায় । বেনারসে ও যখন এম. এ. পড়ছিল তখন অরুণিমা ছিল ওর রুমমেট । বিয়ে নিয়ে ওর সঙ্গে অরুণিমার যেসব কথাবার্তা হয়েছিল মনে পড়ে যায় তার ।
--- ইবেতোম্বী, তোমার বিয়ের কথা কিন্তু আমাকে অবশ্যই জানাবে । আমি তোমাদের ওখানে যাবো । তোমার বিয়ে এবং মণিপুর -  দুটোই দেখবো । --- পাগলি কোথাকার । তোমার আমার মধ্যে কার আগে বিয়ে হবে জান তুমি ? --- আমার বিয়ে যদি আগে হয় তাহলে আমি আমার বরকে সঙ্গে নিয়ে মণিপুরে আসবো । আর তোমাকেও কিন্তু আমার বিয়েতে আসতে হবে । --- যাবো, তোমার বিয়েতে অবশ্যই যাবো । সময় আসুক । আমার বিয়ে কিন্তু অনেক দূর । --- তা প্রেমের বিয়ে না পারিবারিক সম্বন্ধ করে বিয়ে --- এই দুটোর মধ্যে কোন্‌টা তোমার পছন্দ ? --- সম্বন্ধ করে বিয়ে । এটাই আমার পছন্দ । আমি হচ্ছি বৈরাগিনীর মতো । প্রেম জিনিসটা কি আমি কোনদিন বুঝিই নি, আর বোঝারও ইচ্ছে নেই । তবে আমার বর হবে হাজার লোকের মধ্যে এমন একজন যার ব্যক্তিত্ব হবে শ্রেষ্ঠ । কোন অধ্যাপকের মতন । --- তাই-ই ? --- তবে জেনে রেখো, আমি ইতিমধ্যে বিয়েই করছি না । ভবিষ্যতেও সম্ভব না হলে বিয়েই করবো না । আমার অনেক ছোটভাই আছে; ওদেরকে আগে মানুষ করতে হবে যে । --- ঠিক আছে । তোমাকে বর দিচ্ছি মনের মত বর যেন তুমি খুঁজে পাও । --- তোমার বর মাথা পেতে নিলাম । এবার আমিও তোমাকে বর দিচ্ছি তুমিও যেন তোমার মনের মানুষটাকে তাড়াতাড়ি খুঁজে পাও ।
তারপর দুজনের কি হি হি হাসি । ইবেতোম্বীর এখন মনে হয়, অরুণিমার দেওয়া বরটা নিষ্ফল হয় নি মোটেই । তা জেনে অরুণিমাও নিশ্চয়ই খুব খুশি । এইসময় প্রফেসর মণিবাবু আস্তে আস্তে ঘরে ঢোকেন । ইবেতোম্বীর কাছে কাছে এসে বসেন । তারপর ইবেতোম্বীর নরম আঙুলগুলিকে মুঠোয় ধরে জিজ্ঞেস করেন, কি ভাবছ ? লজ্জায় লাল হয়ে যায় ইবেতোম্বী । হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে যায় । কি যে উত্তর দেবে ভেবেই পায় না । তাই চুপ থেকে যায় । আবার প্রশ্ন আসে, কার কথা ভাবছ ? এবার ইবেতোম্বীকে উত্তর দিতেই হয় । সে বলে, বন্ধুবান্ধবদের দেওয়া উপহারগুলি দেখছিলাম । বন্ধুবান্ধবদের কথাও ভাবছিলাম ।
--- কি ধরনের বন্ধুবান্ধব ? মনের মানুষ ? কিংবা ব্যর্থ প্রেমিক ?
প্রশ্নগুলি শুনে একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় ইবেতোম্বী । বাসরঘরে এসব কি ধরনের প্রশ্ন ! একেবারে ছেলেমানুষের মতো ! এরপরেই ইবেতোম্বীর মনে হয়, জ্ঞানীলোকেরা বোধহয় একটু ছেলেমানুষই থাকেন । তাই সে উত্তর দেয়, আমার বন্ধুরা শুধু বন্ধুই । আপনিই আমার জীবনের প্রথম পুরুষ ।
--- আর মণিপুরের বাইরে ?
এবার ইবেতোম্বীর মনে হয়, তার প্রফেসর স্বামীটি কি ধরনের মানুষ ! প্রথম কথাবার্তাতেই শুধু উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে যাচ্ছেন ! সেও কেন ছেড়ে দেবে ? এবার সেও বলতে আরম্ভ করে, সত্যি বলছি, ওধরনের লোক আমার কেউ ছিল না। এবার আপনার কথা বলুন, আপনার কোন প্রেমিকা ছিল কিনা।
--- বাব্বা । এই তো কথা ফুটেছে দেখছি । আমার দিকে তাকাও দেখি । আমি তো ভেবেছিলাম চুপ থাকা একজন পাগলি ।
--- আপনি যদি আমার কথা বিশ্বাস না করেন তাহলে বেনারসে হোস্টেলের আমার রুমমেটের কাছে খোঁজ নিতে পারেন । আমার রুমমেট ছিল মহিলাই, নাম অরুণিমা । এই যে দেখুন এটা ওর দেওয়া উপহার ।
--- তাই নাকি ? বেশ সুন্দর উপহার তো ।তা এতোগুলি উপহারের মধ্যে অন্য আর কারুর উপহার কি থাকতে পারে না ? ঐ যে, ঐ বড় প্যাকেটটা। ওটা হয়তো তোমাকে দেওয়া তার উপহার হতেও পারে।
--- ঠিক আছে । খুলেই দেখা যাক কার দেওয়া ।
একটু রেগেই হয়তো ইবেতোম্বী বড় প্যাকেটটাকে টেনে নেয় এবং খুলতে শুরু করে । প্রফেসর সাহেব মুচকি মুচকি হাসতে থাকেন । উপহারটা কাগজের পর কাগজ দিয়ে প্যাঁচানো । ইবেতোম্বী কাগজের পর কাগজগুলি খুলতে থাকে ।
প্রফেসর সাহেব হেসে ওঠেন, ভয়ের ব্যাপার মনে হচ্ছে । ভেতরে কোন কাটা হাত নেই তো ?
এবার ইবেতোম্বীও একটু হেসে ওঠে, কি জানি । এপ্রিল ফুলও হতে পারে ।
--- আমি কিন্তু শেষ না দেখে ছাড়ছি না ।
--- আমিও আপনাকে শেষ না দেখিয়ে ছাড়ছি না ।
সমস্ত কাগজগুলি খোলার পর এবার একটা কাগজের পুঁটলি বেরিয়ে আসে । পুঁটলির ওপরে একটা কাগজ লাগানো। তাতে লেখা, ‘আপনার শুভদিনে আমার এ ক্ষুদ্র উপহারটুকু দিলাম । গ্রহণ করবেন’।
লেখাগুলি পড়ে ইবেতোম্বী বলে ওঠে, এটা তো আমার উপহার না । আপনাকেই পাঠিয়েছে কেউ । আচ্ছা দেখি ভেতরে কি আছে । পুঁটলির কাপড়টা টেনে খুলতেই ইবেতোম্বী ভীষণ চমকে যায় । ভেতরে একটা অপরিণত শিশুর মৃতদেহ । ভয় পেয়ে ‘ও মাগো’ বলে ইবেতোম্বী দুহাতে মুখ ঢেকে ফেলে ।
কিছুক্ষণ পর সে যখন মুখ থেকে দুহাত সরায় তখন সে দেখে, সামনে প্যাকেটটা নেই, প্রফেসর সাহেবও নেই ।

( লমাবম গোজেন্দ্র মণিপুরের একজন গল্পকার । পেশায় অধ্যাপক । ইদানীং তিনি নাট্যচর্চার দিকে ঝুঁকে পড়েছেন । নাটক মঞ্চস্থ করছেন । কিন্তু গল্প লেখা একেবারেই ছেড়ে দেন নি । দুটো গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে । উপহার গল্পটি তাঁর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ থেকে নেওয়া )


                                                  HOME

[এই লেখাটা শেয়ার করুন]