best website builder free
হরিভূষণ পাল           সিঁদুরের ভাষা

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]



গল্প           Home


ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে দুজন চুপ করেই থাকল অনেকটা সময়। পাশাপাশি হাঁটছে, কিন্তু কারো মুখে কোন কথা নেই। যেন বলার মতো কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। অথচ কথার পাহাড় জমে আছে দুজনের বুকে। রিক্সায় উঠে প্রথম কথা বলল মনীষা --- এই এক ফ্যাশন হয়েছে আজকাল। সাধারণ কিছু হলেও বলে দেয় বায়োপ্‌সি করাও। ডাক্তার না ঘোড়ার ডিম। যত্তোসব হাতুড়ে!
মনীষা কথা ক-টি বলল বটে, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরের কৃত্রিমতা নিজের কানেই বেসুরো ঠেকল। সে নিজেও জানে অতনুর অসুখটা মোটেও সাধারণ কিছু নয়। আজ ডাক্তারের কাছে আসার আগেও সন্দেহের বেশ কয়েকটি ঢেউয়ের ঝাপটায় ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠেছিল তারা দুজনেই। মনের কথা হয়তো কেউ কাউকে খুলে বলেনি, কিন্তু দুজনেই বুঝেছিল, ডাক্তারবাবু শেষপর্যন্ত এমন কিছু একটা বলে দেবেন। এই তিন-চারমাসে কম ট্যাবলেট-ক্যাপসুল খায়নি অতনু, কম ডাক্তার দেখায়নি। কিন্তু তার গলার ব্যথাটার কো-ন-ও পরিবর্তন নেই। আজও ডাক্তারবাবু সব দেখেশুনে প্রেসক্রিপশন লিখতে গিয়েও লিখলেন না। গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন চেয়ারে হেলান দিয়ে। কপালে ভাঁজ পড়ল। হাতের কলমটা দু-আঙুলে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে শেষপর্যন্ত বলেই দিলেন,
--- ওষুধ তো আর কম লিখলাম না। কিছুতেই কোন রেসপন্স নেই ! এখন তো মনে হচ্ছে একটা বায়োপ্‌সি করানো দরকার। কনফার্ম হয়ে যাওয়া ভালো।
অতনুর দিকে নয়, ডাক্তারবাবু কথা ক-টি সামনের চেয়ারে বসা মনীষার দিকে চেয়েই বললেন। অতনু বুঝে যায়, ডাক্তারবাবু এখন তাকে আর ধর্তব্যের মধ্যে গণ্য করছে না। সে এখন খরচের খাতায়। তবু একবার ফ্যাকাসে গলায় বলল,--- আপনি কি অন্যকিছু সন্দেহ…
ডাক্তার যেন তার মুখের কথা কেড়ে নিলেন। বলে উঠলেন,
--- সন্দেহ যে করতেই হয়। এতসব পাওয়ারফুল ক্যাপসুল, তবুও কোন রেসপন্স নেই। এ অবস্থায় কিছুটা সন্দেহ যে করতেই হয়। আর লোকেশনটাও যে খুব সেন্সেটিভ।
অতনু আর মনীষা দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে ডাক্তারবাবু তাঁর দুচোখে ভরসার এক হালকা মেঘ ভাসাতে চেষ্টা করেন। বললেন,--- বায়োপ্‌সি মানেই কিন্তু খারাপ কিছু নয়। রিপোর্টে নেগেটিভও আসতে পারে। সে যাই হোক, একটা কনফারমেশন দরকার। হাসপাতালেই করিয়ে নেবেন। আমি সব লিখে দিচ্ছি।
এবারও ডাক্তারবাবু কথা ক-টি মনীষার দিকে চেয়েই বললেন।হাতের কাগজটাও এগিয়ে দিলেন তার দিকে। যেন মনীষাই এখন অতনুর গার্জিয়ান। তার ভালো-মন্দ নিয়ে ভাবনাচিন্তার দায়দায়িত্ব এখন থেকে মনীষার। অতনু শুধু রুগি। তাও যেমন তেমন রুগি নয়, বায়োপ্‌সি পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া এক অসহায় রুগি।
ডাক্তারের কথা শুনে অতনু আর মনীষার মনের গোপন সন্দেহটা বদ্ধমূল হয়ে যায়। দুজনেই বুঝতে পারে, ডাক্তারবাবু মুখে যাই বলুক, বায়োপ্‌সির রিপোর্ট নেগেটিভ হবে না। সে সম্ভবনা নেই। এ ক-মাস কম ডাক্তার দেখায়নি অতনু, কম ওষুধ খায়নি। চার বর্ণের সেই মারাত্মক রোগটার নাম সরাসরি কেউ উচ্চারণ না করলেও সন্দেহ সবার মনেই ছিল। আজ ডাক্তারের মুখে বায়োপ্‌সির কথা শুনে তাই কেউ চমকে ওঠেনি। শুধু এক বুক নীরবতা নিয়ে বেরিয়ে আসে ডাক্তারের চেম্বার থেকে। চুপচাপ পাশাপাশি হাঁটতে থাকে, যেন বলার মতো কথা খুঁজে পাচ্ছে না কেউ। দমবন্ধ নীরবতার সেই ঘন কুয়াশাকে কিছুটা হালকা করতেই মনীষা বলে ওঠে,
--- এই এক ফ্যাশন হয়েছে আজকাল। সাধারণ কিছু হলেও বলে দেয় বায়োপ্‌সি করাও। ডাক্তার না ঘোড়ার ডিম। যত্তোসব হাতুড়ে !
অতনু সারাক্ষণ চুপ করেই ছিল। একবার শুধু মনীষার দিকে চেয়ে বলতে চেষ্টা করে,
--- তুমি দেখো, বায়োপ্‌সির রিপোর্ট নেগেটিভ হবে না। আমার মন বলছে… কাশির দমকে অতনু তার কথাও শেষ করতে পারে না। শুনে মনীষা গলায় ধমকের ঝাঁজ এনে বলে ওঠে --- হ্যাঁ, নেগেটিভ হবে না ! বলেছে তোমাকে ! আগেই সব জেনে বসে আছো ! ও কি ? তুমি গলার মাফলারটা দাওনি কেন ? ঠাণ্ডা লেগে আবার কী থেকে কী হয় ! কই, দেখি মাফলারটা।
অতনুর গলায় মাফলার পরিয়ে দেবার সুযোগে মনীষা কথা ঘোরায়।
অতনুর গলার এই ব্যথাটার পর থেকে মনীষার বয়স যেন এক ধাপে অনেকটাই বেড়ে যায়। প্রথম দিকে যাই হোক, দু-তিনজন ডাক্তার দেখিয়েও যখন কিছুতেই কিছু হল না, তখন থেকেই এক পাথরচাপা গাম্ভীর্য বুকে চেপে সদা চঞ্চল হাসিখুশি মনীষা তাদের দুজনের ছোট্ট সংসারটাকে ধীরে ধীরে কাঁধে তুলে নিতে থাকে। প্রাথমিক আতঙ্ক আর অসহায় অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হয়তো কিছুটা সময় নিয়েছে, কিন্তু এখন, বিবাহিত জীবনের দুবছরের মধ্যেই, মনীষা এক রাশভারী ঘরনি, রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি এক গৃহকর্ত্রী, অসুস্থ অতনুর উদিগ্ন অভিভাবিকা। অতনু অবাক হয়। ভাবে, দুঃসময় মানুষকে ক-ত বদলে দেয়। কলেজ জীবনে এই মনীষাই ছিল আবেগ-উচ্ছ্বাসে ভরপুর এক সাতরঙা প্রজাপতি। সংসারের কঠিন মাটিতে তার মতো কাঁচের ঘরের একটা মেয়ে কতটুকু মানিয়ে চলতে পারবে, তা নিয়ে অতনুর দ্বিধাও কম ছিল না। তাদের দীর্ঘ চার বছরের প্রেমের অধ্যায়ে এটাই ছিল তার সবচেয়ে বড়ো দুঃশ্চিন্তা। অথচ এ নিয়ে কোন কথা উঠলে মনীষা সব কিছু ভাসিয়ে দিত আবেগের বন্যায়। বাস্তব জীবনটাকেও সে ভাবত টিভির পর্দায় ভেসে ওঠা কাহিনির মতোই নিটোল আর মসৃণ।
বাড়ি ফিরে মনীষা বলল, --- তুমি যেন এক্ষুনি আবার বিছানায় গড়াতে যেয়ো না। আগে স্নান করে নাও।
--- এই অবেলায় আবার স্নান কেন ? হাতমুখ ধুয়ে নিলেই হবে।
--- না, শুধু হাতমুখ নয়, স্নান করে নাও। ডাক্তারের ওখানে কত ধরনের রোগী যায় তার কিছু ঠিক আছে ? আমি জল গরম করে দিচ্ছি। ভালো করে স্নান করে নাও।
বারান্দায় চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে বসে ভাবছিল অতনু। এতদিন কিছুটা সন্দেহ থাকলেও মনের কোণায় ক্ষীণ একটা আশার আলোও ছিল। আজ ডাক্তারের কথা শোনার পর চারিদিকে অন্ধকার দেখতে শুরু করে। অথৈ সমুদ্রে ডুবন্ত মানুষের মতো আঁকড়ে ধরার কোন অবলম্বন খুঁজে পায় না। স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনার সব ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। সবকিছু যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে। সব এলোমেলো। ভাবনার কোন একটি সূত্র ধরে এগুতে পারেনা কিছুতেই। তার অসুখ – বায়োপ্‌সি রিপোর্ট – মৃত্যুভয় – মনীষা টাকা-পয়সা, এমন অসংখ্য টুকরো টুকরো ঝাপসা দৃশ্য ভেসে উঠতে থাকে চোখের সামনে। এখন টাকা-পয়সা নিয়েই তার সবচেয়ে বড়ো ভাবনা। এ ক-মাসে অনেক টাকাই বেরিয়ে গেছে জলের মতো। সামনে আরও যে কত টাকার ব্যাপার, তার কোন ধারণাও অতনুর নেই। ফিক্সড পে-র চাকরিটা পাবার পরই বিয়ের ঝুঁকিটা মাথায় নেয়। তার কিছুটা দোনামনা ভাব থাকলেও ভরসা যুগিয়েছিল মনীষা। সাহস দিয়ে বলেছিল,
--- এর চেয়ে কম বেতনের মানুষও বিয়ে করে, সংসার করে। তাছাড়া সবসময় কি আর এমন ফিক্সড পে থাকবে? নাহয় কষ্টই করলাম দু-এক বছর। আর তুমি দেখে নিয়ো, চাকরি আমিও একটা ঠিক যোগাড় করে নেব।
মনীষার দুচোখে তো তখন শুধু স্বপ্ন ভাসত। দীর্ঘশ্বাস চাপে অতনু। ভাবে, শুধু দু-এক বছর নয়, হয়তো সারাটা জীবনই তাকে কষ্ট করতে হবে। আবার অতনুকেই বিয়ে করবে বলে গোঁয়ার্তুমি করে বাড়ি থেকেও বেরিয়ে এসেছে। এখন যে বাপের বাড়ির দরজাও তার কাছে বন্ধ।
স্নান সেরে অতনু ঘরে এসে দেখে সব পরিপাটি করে গোছানো। বিছানার চাদরটাও ধপধপে পরিষ্কার। সামনের টেবিলের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রাখা। তার ট্যাবলেট-ক্যাপসুল সব রাখা আছে খাটের পাশে ছোটো টেবিলটাতে। আজ অনেকটা সময় নিয়ে স্নান করেছিল অতনু। আসলে স্নান করতে গিয়ে কিছুক্ষণ একা থাকতে চেয়েছিল। সময় পেয়ে মনীষা তাই ঘরদোর সব গুছিয়ে রেখেছে। হাতের কাজকর্ম ছেড়ে এবার সেও গেল স্নানের ঘরে। অনেকটা সময় নিয়ে স্নান করা মনীষার এক ধরনের বিলাসিতা। আগে তো স্নানের ঘরে গানও গাইত গুনগুনিয়ে। বলত, স্নান মানে তো শুধু শরীর ভেজানো নয়, মনটাও ভেজানো। অতনু বুঝতে পারে, আজও মনীষা স্নান করতে অনেকটা সময় নেবে। স্নানের সুযোগে সেও কিছুক্ষণ একলা থাকতে চাইবে। হয়তো দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলে হালকা করতে চাইবে নিজেকে। সব বুঝতে পারে অতনু। বুঝতে পারে, তার সামনে মনীষা মুখে হাসি ফোটাবার চেষ্টা করলেও বুকে জমে আছে বরফের পাহাড়। স্নানের ঘরের নির্জনতায় তাই একটু হালকা হতে চাইবে। নিজেকে দাঁড় করাতে চাইবে নিজের সামনে। সব বুঝতে পারে অতনু। শুধু তার নিজের কথা নয়, মনীষার কথা ভেবেও বুকটা ভারী হয়। দীর্ঘশ্বাস চাপে।
আবার মনে মনে এমনই একটা সযোগেরর অপেক্ষায় ছিল সে। মনীষার চোখের আড়ালে সে একটা কাগজ খুঁজে দেখতে চায়। মনীষার সামনে কিছুতেই সেই কাগজটা খুঁজতে পারবে না অতনু। তাই ঘরে মনীষার অনুপস্থিতির সুযোগ খুঁজছিল মনে মনে। কাগজ মানে ইন্সিওরেন্স-এর প্রিমিয়ামের একটি রসিদ। কয়েকটা দিন থেকেই মনে মনে ভেবে রেখেছে কথাটা। ছোট্ট সে রসিদটা খুঁজে নিয়ে যত্ন করে গুছিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু মনীষার চোখের আড়ালে খোঁজার মতো সুযোগ এখনও পেয়ে ওঠেনি। আজ ডাক্তারের চেম্বার থেকে ফেরার পথে ভেবে রেখেছে, সময় সুযোগ করে আজই খুঁজতে হবে রসিদটা। ব্যাপারটা হয়তো গোপন কিছু নয়, তবু মনীষার সামনে খুঁজতে গেলে তার বুকটা যে আরও ভারী হয়ে যাবে। এমনিতেই তো বুকে পাথর চেপে থাকে সবসময়। তার মুখে যে কবে হাসি দেখেছে, তাও ভুলে গেছে অতনু। তার অসুখ, ডাক্তারের বায়োপ্‌সির কথা বলা সব মিলিয়ে এমনিতেই তো দিশাহারা। আবার তার সামনেই ইন্সিওরেন্সের রসিদ খুঁজতে গেলে হয়তো বেচারি কেঁদেই ফেলবে। অতনু ভাবে, আজ তো মনীষা স্নানের ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে অনেকটা সময় নেবে। এ সুযোগেই খুঁজে দেখতে হবে রসিদটা। ইন্সিওরেন্সের কথাটা মনীষাও জানে। তাকেই নমিনি করার কথা শুনে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলেছিল,
--- বালাই ষাট ! তুমি না থাকলে ও টাকা দিয়ে আমার কি হবে ! কালই গিয়ে বরং সব পালটে এসো। পলিসিটা হোক আমার নামে, আর নমিনি থাকবে তুমি। চারিদিকে যেরকম বধূ হত্যা চলছে, তুমি নমিনি থাকলেই তো ভালো হবে।
ফিক্সড পে-র চাকুরিটা পাওয়ার পর, এক পরিচিত এজেন্টের পাল্লায় পড়ে প্রায় বাধ্য হয়েই ইন্সিওরেন্সটা করেছিল অতনু। বছরে দুবার প্রিমিয়াম। মোটামুটি ভালো টাকাই দিতে হয়। সবসময় পেরেও উঠে না। কয়েকবার তো এজেন্ট নিজেই টাকা জমা দিয়ে দিয়েছে। ধীরে ধীরে মিটিয়ে দিয়েছে অতনু। কোন্‌ কোন্‌ মাসে প্রিমিয়ামটা দিতে হয়, তাও ঠিক মনে থাকে না তার। এজেন্টই সব মনে করিয়ে দেয়। এতদিন তো এসব নিয়ে তার কোন মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু এই অসুখটার পর থেকে ইন্সিওরেন্স-এর কথাটাই মনে আসে সবার আগে। ভাবে, তেমন কিছু ঘটে গেলে, ঐ টাকা কটি কিছুটা হলেও সহায় হবে মনীষার।
স্নানের ঘরের দিকে আরেকবার চোখ বুলিয়ে অতনু তোষকের কোণটা একটু তুলে ধরে। খুঁজতে থাকে রসিদটা। তোষকের নিচেই তো এরকম টুকটাক কাগজ রাখে সে। প্রথমে একবার হাতের কাছে তোষকের নিচে, পরে সময় করে প্রয়োজনমতো গুছিয়ে রাখে আলমারিতে। তার অসুখের আগে তো আর রসিদটাকে তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি। নইলে অন্য কোথাও গুছিয়ে রাখত।
কিন্তু অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না রসিদটা। সবকিছুই রয়েছে, ডাকে আসা চিঠি রয়েছে দু-তিনটে, ইলেকট্রিকের বিল রয়েছে, পরিচিত দু-একজনের বিয়ের চিঠি রয়েছে, তার পুরোনো প্রেসক্রিপশন রয়েছে, শুধু প্রিমিয়ামের রসিদটাই নেই। কোথায় যে রেখেছে তাও অবশ্য পুরোপুরি মনে করতে পারছে না। ডাক্তারের মুখ থেকে ওই কথাটা শোনার পর ঠিকঠাক ভাবনাচিন্তার ক্ষমতাও যে হারিয়ে ফেলেছে। তোষকের কোনাটা আরও একটু তুলে ধরে দেখল অতনু। না, সেদিকেও নেই। আর কাগজটা অতটা ভেতরে যাবার কথাও নয়। তাহলে কি সে নিজেই আলমারির ফাইলটাতে গুছিয়ে রেখেছে ? ঠিক মনে করতে পারে না। আর মনীষার তো এসব দিকে কোনও নজর নেই। সে আছে তার ঘর সাজানো নিয়ে। কিন্তু এখন যে আলমারিটা খুলে দেখার সময় হবে না। হয়তো মনীষা এখুনি স্নান সেরে বেরিয়ে আসবে। মনীষা ঘরে আসার আগেই অতনু আবার নিজেকে এলিয়ে দেয় বিছানায়। ভাবে, সুযোগ করে কালই আলমারিটা খুলে দেখবে একবার।
আরও একটু পরে স্নান সেরে ঘরে আসে মনীষা। হালকা হলুদ শাড়ি পরেছে একটা। গিয়ে দাঁড়াল লম্বা আয়নাটার সামনে। সারা পিঠে ছড়িয়ে আছে লম্বা চুলের গোছা। শরীরে লেগে আছে স্নিগ্ধতার ছোঁয়া। খাটে শুয়েই অতনু চেয়ে থাকে মনীষার দিকে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকার মতো সুন্দরী হয়তো নয়, কিন্তু চোখে-মুখে এক অনন্য বিশিষ্টতায় উজ্জ্বল। ছোট্ট সুন্দর মুখখানিতে যে টলটলে লাবণ্যের আভা, তা সচরাচর নজরে পড়ে না। টানা টানা চোখ দুটিতে সবসময় ভেসে থাকে এক স্বপ্নিল আবেশ। চেয়ে চেয়ে ভাবতে থাকে অতনু। অসুখটার পর থেকে এমন মনোযোগ দিয়ে আর কখনও তাকিয়ে দেখেনি মনীষার দিকে। মনীষাও অতনুর অপলক তাকিয়ে থাকা টের পেয়ে যায়। আয়নার দিকে তাকিয়েই বলে ওঠে,
--- অমন করে কী দেখছ ?
--- দেখছি। অনেকদিন তোমাকে ভালো করে দেখিনি।
--- ছ-বছরেও ভালো করে দেখা হয়নি ?
--- ছ-বছর কেন, সারা জীবনেও তোমাকে দেখা শেষ হবে না।
ভিজে চুলে চিরুনি চালাচ্ছিল মনীষা। চিরুনিটা একপাশে রেখে এবার হাত বাড়ায় সিঁদুরের কৌটোর দিকে। অতনুর কথা শুনে ঠোঁট দুটিতে ক্ষীণ এক খুশির রেখা ভাসিয়ে তুলতে চেষ্টা করলেও, অতনু বুঝতে পারে, বুক ভরা বিষাদের সমুদ্র ঠেলে খুশিটা ঠিক ভেসে উঠল না। হঠাৎই খাট থেকে নেমে আসে অতনু। বলে।
--- একটু দাঁড়াও তো। এখুনি সিঁদুরটা দিও না।
--- কেন ?
মনীষা অবাক। তার দু-আঙুলে সিঁদুরের কৌটো।
--- কপালে সিঁদুর না থাকলে তোমায় কেমন দেখাবে, একটু দেখি।
কথাটা শুনে বুকটা কেঁপে অঠে মনীষার। সব বুঝেও কথা ঘোরায়। ছদ্মবিস্ময়ে বলে,
---সিঁদুর দেবার আগে তুমি যেন আমায় দেখনি।
---আরে তেমন দেখা নয়, আমি না থাকলে সিঁদুর ছাড়া তোমাকে কেমন দেখাবে---- তাই একটু দেখতে ইচ্ছে করছে।
অতনু এগিয়ে যায় আয়নার দিকে। চমকে উঠে মনীষা বলে,
--- কীসব অলুক্ষুণে কথা ! ঠিক ভর সন্ধেবেলায় এমন কথা বলতে তোমার একটুও আটকালো না ?
সামনে গিয়ে দাঁড়ায় অতনু। মনীষাকে তার দিকে ঘোরাতে দু-হাত বাড়ায়। অসাবধানে মনীষার হাত থেকে সিঁদুরের কৌটোটা পড়ে যায় টেবিলে। ছিটকে পড়া সিঁদুরে লাল হয়ে যায় সারা টেবিল। হতভম্ব মনীষা বলে ওঠে,
--- কী করলে বলো তো ! তোমার হঠাৎ কেন যে এমন বেয়াড়া ইচ্ছেটা হতে গেল ! জানো, হাত থেকে সিঁদুর পড়ে যাওয়া অমঙ্গলের লক্ষণ ।
ঘটনার আকস্মিকতায় অতনুও বিমূঢ়। সামলে নিয়ে বলে,
--- লক্ষণ আবার কী ! অমঙ্গলের আর কিছু কি বাকি আছে ? হয়তো আর বেশিদিন দিতে হবে না বলেই কৌটোটা নিজে থেকেই পড়ে গেল।
নিরুত্তর মনীষা যতটা সম্ভব সিঁদুর আবার তুলতে থাকে কৌটোতে। তার দু-হাতেও ছোপ ছোপ সিঁদুরের লাল দাগ। মাথা নিচু করে আছে বলে বোঝা যাচ্ছে না, তবু অতনুর মনে হল, তার দু-চোখে জল। হয়ত তাই একবারও মুখ তুলে তাকাচ্ছে না অতনুর দিকে।
সন্ধ্যার একটু পরে মনীষা গেল রান্নাঘরের দিকে। এখন সে দু-কাপ চা করবে। জলখাবারও করবে কিছু একটা। সুযোগ বুঝে অতনু আবার খুঁজতে গেল প্রিমিয়ামের রসিদটা। তখন তাড়াতাড়ির মাথায় হয়তো সবকিছু দেখা হয়নি। এখন তার মনে হচ্ছে তোষকের নিচেই রেখেছিল কাগজটা। আলমারিটা খোলার আগে তোষকের নিচে আর একটু ভালো করে দেখা দরকার। মনীষার চা-টিফিন তৈরির সুযোগে অতনু আবার গিয়ে তুলে ধরল তোষকের কোনাটা। একটু তুলে ধরতেই দেখল, প্রায় সামনেই পড়ে আছে সেই খামটা। জীবনবিমার আরশোলা রং-এর খামটা তো দেখলেই চেনা যায়। ঠিকানার জায়গাটাতে আবার জানলার মতো খুপরি কাটা। অবাক হল অতনু। সামনেই পড়েছিল, অথচ তখন একবারও চোখে পড়েনি। তাড়াতাড়ি খামটা হাতে নিয়ে ভেতরের রসিদটা বের করতে গিয়ে দ্বিতীয়বার অবাক হয় সে। দেখে, খয়েরি রং-এর খামটার গায়ে লেগে আছে সিঁদুরের দু-একটি হালকা লাল ছাপ। দেখলেই বোঝা যায়, সিঁদুর লাগা হাতে কেউ খুলেছিল খামটা। ভেতরের রসিদটাতেও আবছা কয়টি লাল ছাপ।
নিজের অজান্তেই অতনুর চোখ জোড়া ঘুরে যায় রান্নাঘরের দিকে। দেখে উনুনে জল ফুটছে, আর মনীষা অবন পটুয়ার ছবির মতো জানলা ধরে তাকিয়ে আছে দূরের আকাশের দিকে।


                                                     HOME  

[এই লেখাটা শেয়ার করুন]