দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ – সুদীপ ঘোষাল

দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ

সুদীপ ঘোষাল

কলকাতা হাইকোর্টের সলিসিটর ভুবনমোহন দাশ বাস করেন কলকাতার এক মধ্যবিত্ত সংসারে। ব্রিটিশ ভারতের অধীনে ১৮৭০ সালের ৫ই নভেম্বর তাঁর ঘর আলো করে জন্ম নিল এক শিশু। ভুবনমোহনবাবু তাঁর নাম রাখলেন চিত্তরঞ্জন। চিত্ত, ছোট থেকেই খুব বুদ্ধিমান ও সাহসী ছেলে ছিল।

কলকাতার পটলডাঙা স্ট্রিটে তাঁর জন্মস্থান। ছোটবেলায় স্কুলে কোনদিন দ্বিতীয় হননি। প্রখর বুদ্ধিমান এই চিত্ত খুব দয়ালু ছিলেন। দলগঠনের একটা সহজাত গুণ তাঁর ছিল। চিত্তরঞ্জন বন্ধুদের বলতেন, কি হবে নিজেদের মধ্যে বিদ্বেষ পুষে রেখে। সবই ক্ষণস্থায়ী। আয় আমরা সবাই এক হওয়ার মন্ত্রে দীক্ষিত হই। তারপর বন্ধুদের সঙ্গে মিলে দুয়ারে দুয়ারে চাঁদা তুলে গরীব অসহায়দের সেবা করতেন। বন্ধুরা একবার তার খুঁজে বেরুলে পটলডাঙার বস্তিপাড়ায় তাঁকে খুঁজে পায়। বন্ধুরা বলে, কি রে কি করছিস এখানে, আমরা খুঁজে খুঁজে হয়রান। চিত্ত বললেন, আমি সময় পেলে এই অসহায় বুড়োবুড়িদের সেবা করার চেষ্টা করি। তার বন্ধু অমল বলে, আমাদের বলে তারপর আসবি তো। চিত্ত বললেন, সেবা, দান  লুকিয়ে করতে হয়। এমনভাবে করতে হয় যেন ডানহাতে সেবা করলে বামহাতও জানতে না পারে। অমল তার কথা শুনে বলে, তুই একদিন মস্ত বড় মানুষ হবি। লোকে তোকে পুজো করবে।

তারপর কলেজ থেকে বিএ পাশ করার পর বন্ধুরা সকলে এদিক ওদিক ছিটকে পড়ে সংসারের চক্রে। ১৮৯০ সালে গ্র্যাজুয়েট হওয়ার পর  লন্ডন যান উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। ১৮৯৪ সালে ব্যারিস্টার হয়ে ফিরে এসেছিলেন। তারপর ফিরে এসে বন্ধুদের সঙ্গে করে মেয়ে দেখে এলেন বিয়ে করার উদ্দেশ্যে। ১৮৯৭ সালের ৩ ডিসেম্বর ব্রাহ্মধর্মের আচার মেনে বিয়ে হয় চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে বাসন্তী দেবীর। সেইসময় উদারপন্থী শিক্ষিত ব্রাহ্মসমাজকেও অযৌক্তিক গোঁড়ামির পথে হাঁটতে হয়েছিল। চিত্তরঞ্জন বুঝেছিলেন, সংস্কারমুক্ত মনের প্রসার ও প্রচার দরকার। উদারমন ও স্বাধীন সমাজ গঠনের ব্রত নিলেন। তখন চিত্তর সাংসারিক অবস্থা খুব একটা সচ্ছল ছিল না। দারিদ্রের সঙ্গে ধুলোমাখা, কাঁটাপথে তাঁর চলা শুরু হল। ঋণভারে জর্জরিত পিতাকে দেখতে হয়েছিল। চিত্তর পিতা বলতেন, যত কঠিন সময়ই আসুক, ভেঙে পড়বি না চিত্ত। মানুষের সেবা করা পরম ধর্ম। মানুষের সেবা করে যাবি আজীবন।

চিত্তর ছোটবেলার বন্ধু ছিল রহমত আলি, বশির সেখ, অমল, দীনু। চিত্ত ছোটবেলার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে আলিপুরে ঘুরতে গেল। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে এল। চিত্ত বন্ধুদের কাছে বিদায় নিয়ে আবার নবউদ্যমে কাজে নেমে পড়ল। তখনকার দিনে নিজের রোজগার থেকে অধিকাংশ তিনি দান করে দিতেন। তখন তাঁর আয় নেহাত মন্দ নয়। কিন্তু অতিরিক্ত দানের ফলে তিনিও ঋণ করলেন বহু জায়গায়।

পরের উপকার করতে গিয়ে ঋণভারে জর্জরিত হতে হয়েছিল চিত্তরঞ্জন দাশকে। সংসারের অসচ্ছলতার বোঝাও কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল। এরপর শুরু করেছিলেন আইনজীবীর কাজ। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ  হলেন একজন বাঙালি আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, স্বাধীনতা সংগ্রামী, কবি ও লেখক। তিনি স্বরাজ্য পার্টি-র প্রতিষ্ঠাতা। তার সময়ের অন্যতম বৃহৎ অঙ্কের আয় অর্জনকারী উকিল হওয়া সত্ত্বেও তিনি তার সম্পদ অকাতরে সাহায্যপ্রার্থীদের কাছে বিলিয়ে দিয়ে বাংলার ইতিহাসে দানবীর হিসাবে সুপরিচিত হয়ে আছেন। তিনি “দেশবন্ধু” নামেতে জগৎ বিখ্যাত হয়ে আছেন। চিত্তরঞ্জন দাশ লেখালেখিও করতেন। লেখালেখির সূত্র ধরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তিনি রবীন্দ্রবিরোধী ছিলেন একথা সত্য না হলেও এই তথ্যই সকলে জানেন। তার কারণ হয়ত ছিল। তখনকার বড় বড় প্রখ্যাত লেখকরা, ‘নারায়ণ পত্রিকা’য় লিখতেন। নারায়ণ পত্রিকা লেখকদের পারিশ্রমিকও দিত। লেখকদের তালিকা ছিল চোখে পড়ার মত। শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, বিপিনচন্দ্র পাল, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জলধর সেন প্রমুখ। রবীন্দ্রনাথ তখন বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট পরিচিত নাম হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথের কোনও লেখাই নারায়ণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি। বরং নারায়ণ একসময়  রবীন্দ্র-বিরোধিতার অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। নারায়ণের রবীন্দ্রবিরোধিতার পেছনে যে চিত্তরঞ্জন দাশের সায় ছিল তা বলাই বাহুল্য। পত্রিকার প্রায় প্রতি সংখ্যাতেই রবীন্দ্র-সমালোচনামূলক এক বা একাধিক রচনা প্রকাশিত হত। এতে করে সাধারণ লোকের ধারণা তো এইরকম হতেই পারে। তবে চিত্তরঞ্জনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা দেখতে পাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের রচনায়। তিনি লিখেছেলেন,”এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ, মরণে তাহাই তুমি করে গেলে দান।” ১৮৯৪ সালে কলকাতা হাইকোর্টে ব্যারিস্টার হিসেবে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করেন। ১৯০৮ সালে অরবিন্দ ঘোষের বিচার তাকে পেশাগত মঞ্চের সম্মুখসারিতে নিয়ে আসে। তিনি এত সুনিপুণ দক্ষতায় মামলাটিতে বিবাদী পক্ষ সমর্থন করেন যে অরবিন্দকে শেষ পর্যন্ত বেকসুর খালাস দেয়া হয়। তিনি ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলায়  বিবাদী পক্ষের কৌশলী ছিলেন। তিনি দেওয়ানী ও ফৌজদারী উভয় আইনেই দক্ষ ছিলেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশকে বাঙালি যেভাবে মনে রেখেছে কবি, গল্পকার কিংবা প্রাবন্ধিক চিত্তরঞ্জন দাশকে বাংলা সাহিত্য সেভাবে জায়গা দেয় নি। রাজনীতিক চিত্তরঞ্জনের দেশবন্ধু পরিচয়টি পরবর্তীকালে অন্য সব পরিচয়কে ছাড়িয়ে গেলেও, চিত্তরঞ্জনের রাজনৈতিক জীবন ছিল মাত্র ছ’সাত বছরের। কিশোর বয়স থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু। প্রেসিডেন্সি কলেজ জীবনে, বিলেতে, এমনকি দেশে ফেরার পর সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত তাঁর মন থাকত সাহিত্যচর্চায়। নির্মাল্য, মানসী প্রভৃতি পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হত।

তিনি লিখতে খুব ভালোবাসতেন। চিত্তরঞ্জন দাশের কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয় নব্যভারত পত্রিকায়। কবিতার নাম ‘বন্দী। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মালঞ্চ’ প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ সালে, প্রকাশক ছিলেন সুরেশচন্দ্র সমাজপতি। একটা সময় চিত্তরঞ্জন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির খামখেয়ালি ক্লাবের সভ্য ছিলেন। সেখানে বড় কবিদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও অবনীন্দ্রনাথ, গগনেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, প্রমথ চৌধুরী, সঙ্গে কেবল পরিচয় নয় তাদের সঙ্গে তিনি সাহিত্যপাঠ ও সংগীতচর্চায় অংশ নিতেন।

তারপর থেকে কবিগুরুর সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের সম্পর্ক খুব ভালো হয়। চিত্তরঞ্জন বলেন রবীন্দ্রনাথকে, একবার আমার বাড়িতে পদধূলি দেবেন দয়া করে। রবীন্দ্রনাথ সেকথা রেখেছিলেন চিত্তরঞ্জন যখন দ্বিতীয়বার বিলেত যান তখন চিত্তরঞ্জনের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ, ইয়েটস ও রদেনস্টাইনকে নিয়ে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেদিন রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’ কাব্য থেকে কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে চিত্তরঞ্জন দাশও তাঁর সাগর-সঙ্গীত-এর পাণ্ডুলিপি থেকে কয়েকটি কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন। মহাপুরুষেরা এক জায়গায় সকলেই একমত। তাঁদের অন্তের ভালোবাসার ফল্গু সংকীর্ণ হয় না। তাঁরা তো সাধারণ মানুষ নন।

১৯২১ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য তিনি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। পরের বছর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গয়া কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করেন। কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে সাংগঠনিক বিষয়ে বিরোধ দেখা দেওয়ায় তিনি ১৯২২ সালে কংগ্রেসের সভাপতিত্ব ত্যাগ করেন। এরপর তিনি স্বরাজ্য দল গঠন করেন। মতিলাল নেহেরু এবং দেশবন্ধুর নেতৃত্বে এই দল ভারতের অন্যতম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ১৯২৪ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দমানোর জন্য ব্রিটিশ সরকার ‘১ নং বেঙ্গল অর্ডিনান্স’নামে এক জরুরি আইন পাশ করে। তখন চিত্তরঞ্জন দাশ নিজ বাড়িতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকের আহ্বান করেন। গান্ধীজী উপলব্ধি করেন স্বরাজ্য দলকে দমনের জন্যেই এই অর্ডিন্যান্স পাশ করা হয়েছে। এরপর থেকে গান্ধীজী দেশবন্ধুকে অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৪ ও ১৯২৫ সালে পরপর দুবার মেয়র নির্বাচিত হন। তবু বাংলা সাহিত্যে চিত্তরঞ্জন দাশের অবদান প্রসঙ্গে আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে। মূলত চিত্তরঞ্জন দাস সম্পাদিত পত্রিকা নারায়ণ-এর লেখকসুচিতে রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিকে কেন্দ্র করে চিত্তরঞ্জন দাসের রবীন্দ্র বিরোধিতা প্রসঙ্গের অবতারণায়। নিজের পত্রিকায় কোন কবির লেখা না থাকতেই পারে। তারজন্য কবি রবীন্দ্রনাথ কখনও কোন বিদ্বেষ প্রকাশ করেন নি। রবীন্দ্রসাহিত্যের বিষয়ে বিপিনচন্দ্র পাল ওই সময় বাস্তবতার অভাব আছে বলে অভিযোগ করেছিলেন। বিপিন পালের অভিযোগে পুরোপুরি সায় না দিলেও রবীন্দ্রসাহিত্য মূল্যায়নে চিত্তরঞ্জনের বক্তব্য ছিল বিপিন পালের মতোই। অথচ মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্যকেই চিত্তরঞ্জন খাঁটি বাংলা সাহিত্য বলে মনে করতেন। তার এই বক্তব্যের নমুনা মেলে তাঁর ‘বাঙ্গলার গীতিকবিতা, ‘কবিতার কথা’, ‘রূপান্তরের কথা’প্রভৃতি প্রবন্ধে।  চিত্তরঞ্জন বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি ও অন্যান্য যে কোনও কিছুতে পাশ্চাত্য প্রভাবকে ক্ষতিকর বলে মনে করতেন। যে কারণে তিনি পাশ্চাত্যের প্রভাব এড়িয়ে চলার কথা বলতেন। তিনি এ কথাও বলতেন, ব্রিটিশ এ দেশে আসার আগে পর্যন্ত বাঙালি জীবনের সবকিছুই ছিল ভালো। ব্রিটিশ শাসনের ফলেই এ দেশের সবকিছুতে পচন ধরে, বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, বিকৃতি দেখা দেয় এবং তা শেকড়বিচ্ছিন্ন ও বাস্তবসম্পর্কশূন্য হয়ে পড়ে। কেবল জাতীয়তাবাদের প্রশ্নেই নয়, ধর্মচিন্তা, শিল্পনীতি-সহ আরও নানা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের মতের অমিল ছিল খুব স্পষ্ট। শিক্ষার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আদানপ্রদানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯১৭ সালে চিত্তরঞ্জন ‘আমাদের শিক্ষা-দীক্ষার কথা’য় লিখলেন: ‘বাঙ্গলার মাটিতে, বাঙ্গলার ভাষায় যে শিক্ষা সহজে দেওয়া যায় এবং যে শিক্ষা বাঙ্গালী তাহার স্বভাবগুণে সহজেই আয়ত্ত করে সেই শিক্ষাই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট’। চিত্তরঞ্জন পারিবারিক সূত্রে ব্রাক্ষ্ম হওয়া স্বত্বেও নিজের মেয়ের বিয়েতে হিন্দুরীতি পালন করায় ব্রাহ্মসমাজের নেতারা সে-বিবাহ অনুষ্ঠান বর্জন ও চিত্তরঞ্জনকে একঘরে করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেসব উপেক্ষা করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চিত্তরঞ্জনও তাঁর বিরুদ্ধে রবীন্দ্রবিদ্বেষের অভিযোগ অস্বীকার করেন বলেছিলেনঃ ‘কথাটা ঠিক হল না, আমি রবিবিদ্বেষী একেবারেই নই, অলৌকিক প্রতিভা আমি কখনও অস্বীকার করি না, তবে তাঁর সব লেখাই যে ভাল লাগে তা বলতে পারি না’। তার মানে রবীন্দ্র-প্রতিভা নিয়ে চিত্তরঞ্জন দাসের কোনো প্রশ্ন ছিল না। দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য ছিল, তাই চিত্তরঞ্জন হয়ত নিজের অজান্তে রবীন্দ্রবিরোধী অবস্থান নিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তাতেও  নারায়ণ পত্রিকায় রবীন্দ্রবিরোধী লেখা ছাপা হওয়ার পরও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চিত্তরঞ্জনের সৌহার্দ্য কিংবা সৌজন্যতায় কোনও ঘাটতি ছিল না।

সাময়িক সিটি কলেজের ল-লেকচারার হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পারিশ্রমিকের জন্য তাঁকে মফস্‌সলের কোর্টেও সওয়াল করতে দেখা গিয়েছে। মাত্র ২৪ বছর বয়সে তরুণ চিত্তরঞ্জন কাঁধে তুলে নিয়েছেন সংসারের দায়িত্বভার। সাহিত্য সৃষ্টিও জমে ওঠে মনের কোণে। লিখেছেন কবিতাও। প্রকাশ হয়েছে- ‘সাহিত্য’, ‘নির্মাল্য’ও ‘মানসী’ প্রভৃতি পত্রিকায়।

কুতুবদিয়া রাজবন্দী মামলা’দেশবন্ধুকে প্রথম জীবনে একজন আইনজীবী হিসাবে তাঁর দক্ষতা প্রমাণ করতে সহায়তা করেছে। অন্তরীণ-স্থল ত্যাগ করে চট্টগ্রাম যাওয়া ছিল এই মামলায় ১৭ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ। চিত্তরঞ্জন দাস তাঁদের জন্য বিনা ফি’তে কাজ করেন। মামলাটি পরিচালনার জন্য এ সময় তিনি প্রায় পক্ষকালব্যাপী চট্টগ্রামে অবস্থান করেন। দেশবন্ধু যুক্তি দেখান যে, রাজবন্দীরা পালিয়ে যাননি বরং জেলা ম্যাজিট্রেটের কাছে কিছু যুক্তিসঙ্গত ও আইনগত দাবীর জন্যে গিয়েছিলেন। তাঁর চমৎকার কৌশলের কারণে বন্দিদের মাত্র দুই মাসের সাজা হয়েছিল।

আইনজীবী হিসেবে চিত্তরঞ্জন দাশের জন্য ১৯০৭ সাল ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ সময় তিনি সিভিল ও ক্রিমিনাল উভয় কোর্টেই একজন সফল আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিস্থাপন করেন। এ সময় কলকাতা কোর্টে দেশপ্রেমিক ও বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের যত মামলা এসেছে তিনি সেগুলোর বিরুদ্ধে অবিরাম লড়েছেন।

১৯০৮ সালে মুরারিপুকুর বোমা মামলায় বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষের উপর রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ বিনা পারিশ্রমিকে এই মামলায় লড়েন। তখন তাঁর মাসিক আয় ছিল পাঁচ হাজার টাকা। আর এই মামলা পরিচালনা করতে তাঁকে চল্লিশ হাজার টাকা দেনা করতে হয়েছিল। অরবিন্দ ঘোষের বিরুদ্ধে এই মামলা চলে ১২৬ দিন। দু’শর বেশি সাক্ষীকে জেরা করা হয়। ৪০০০ কাগজপত্র এবং ৫০০ জিনিসপত্র প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ ৯ দিন ধরে তাঁর সওয়াল-জওয়াবের সমাপ্তি বক্তব্য দেন। এই মামলায় তিনি যে সওয়াল জওয়াব দেন তা ছিল জ্ঞান ও দেশপ্রেমের অপূর্ব নিদর্শন। বিচারের রায়ে অরবিন্দ ঘোষ মুক্তি পান।

চিত্তরঞ্জন দাশ অর্থ উপার্জনের জন্য রাজনৈতিক মামলার পাশাপাশি মাঝে মাঝে জমিদার, মহাজনদের মামলাও পরিচালনা করতেন। উপার্জিত অর্থ তিনি গরীব-অসহায় জনগণকে দিতেন এবং তা দিয়ে দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের মামলা পরিচালনা করতেন। একবার ডুমরাওনের মহারানীর মৃত্যুর পর রাজা কেশোপ্রসাদ তাঁর সম্পত্তির উত্তরাধিকার না হতে পেরে মামলা করেন। এই মামলায় চিত্তরঞ্জন দাশ প্রতি মাসে ১০,০০০ রুপী পেতেন। আর মামলায় জয়ী হওয়ার পর রাজা কেশোপ্রসাদ খুশি হয়ে চিত্তরঞ্জন দাশকে ৫০,০০০ রুপী দেন।

১৯১০ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ ‘ঢাকা ষড়যন্ত্র মামলা’পরিচালনা করেন। এই মামলার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার অনুশীলন সমিতির প্রধান পুলিন বিহারী দাশ এবং সঙ্গীদেরকে নির্বাসন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও বিভিন্ন মেয়াদে কারদণ্ড দিয়েছিল। কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাশ এই রায়ের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে আপিল করেন। তাঁর আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে তিনজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পরিবর্তে ৬ মাসের শাস্তি এবং ৩৩ জনের মধ্যে ১১ জনের তুলনামূলক কম শাস্তি হয়েছিল।

১৯১৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ ‘দিল্লী ষড়যন্ত্র মামলা’পরিচালনা করেন। এটাও ছিল একটি রাজনৈতিক মামলা। এই মামলার মাধ্যমে তিনি ভারতবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ‘দিল্লী ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার ১৪ জন বিপ্লবীকে লর্ড হার্ডিঞ্জ হত্যা প্রচেষ্টার সাথে যুক্ত করে। কিন্তু চিত্তরঞ্জন দাশের তীক্ষ্ম যুক্তির কাছে ইংরেজ সরকার হেরে যায় এবং তিনি জয়ী হন।

আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও বিপ্লবীদেরকে ব্রিটিশদের অত্যাচার-নির্যাতন ও জেল-জুলুমের হাত থেকে বাঁচানো ছিল তাঁর প্রথম কাজ। আর দ্বিতীয় কাজ ছিল সরাসরি স্বদেশী রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকা এবং পরাধীন ভারতকে স্বাধীন করার জন্য কাজ করা। যে কারণে তিনি ১৯১৭ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।

১৯১৮ সালে ‘আলিপুর ট্রাঙ্ক মার্ডার কেস’ মামলা থেকে তিনি পাঁচ জন ব্যক্তিকে মুক্ত করেন। এই মামলাটি ‘আলিপুর ট্রাঙ্ক মার্ডার কেস, ১৯১৮’নামে পরিচিত। ওই বছর চিত্তরঞ্জন দাশের জীবনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা হল ‘অমৃতবাজার পত্রিকা মামলা’। কলকাতা হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ অভিমত প্রকাশ করে যে, কলকাতা উন্নয়ন ট্রাস্ট কোনো ব্যক্তিগত জমি রাখতে পারবে না। একই সময় হাইকোর্টে অন্য একজন বিচারক রায় দেন যে, কলকাতা উন্নয়ন ট্রাস্ট সেই ক্ষমতা রাখে। এরকম বিপরীতধর্মী মতামতের প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি স্পেশাল ব্রাঞ্চ গঠন করা হয়। প্রধান বিচারপতি Sir Lancelot Sanderson , বিচারপতি Jonh Woodroffe এবং Mr. Chitty নিয়ে এই বেঞ্চ গঠন করা হয়। কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা অমৃতবাজার এ ব্যাপারে মন্তব্য করে সম্পাদকীয় ছাপে। পত্রিকাটি স্পেশাল বেঞ্চের গঠন সম্পর্কেও প্রশ্ন তোলে। এই অবস্থায় প্রধান বিচারপতি অমৃতবাজারকে শোকজ করেন এবং আদালত অবমাননার অভিযোগ আনেন।

‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ তখনকার কলকাতা বারের প্রখ্যাত আইনজীবীদের নিযুক্ত করে। মি. জ্যাকসন, মি. নরটন, বোমকেশ চক্রবর্ত্তী এবং চিত্তরঞ্জন দাশ এই মামলায় নিযুক্ত হন। স্বাভাবিকভাবেই মামলা শুরু করেন মি. জ্যাকসন। কিন্তু পরবর্তিতে একমাত্র চিত্তরঞ্জন দাশ ছাড়া আর কেউই মামলা পরিচালনা করার জন্য ছিলেন না। তিনি একাই অমৃতবাজার পত্রিকার পক্ষে লড়েন এবং বিচারকদের রায় চিত্তরঞ্জন দাশের পক্ষে অর্থাৎ অমৃতবাজার পত্রিকার পক্ষে যায়।

১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে ব্রিটিশ সরকার জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড চালায়। এ হত্যাকাণ্ডে ৩৭৯ জন নিহত এবং প্রায় ১১০০ জন আহত হয়েছিল। ইতিহাসে এটাই ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড’নামে পরিচিত। ব্রিটিশের নানা টালবাহানার পর এই হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠ তদন্ত ও বিচারের জন্য সর্ব-ভারতীয় কংগ্রেস একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, সদস্য ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, মতিলাল নেহেরু, আব্বাস তৈয়্যবজী এবং ড. জাকির হোসেন। তদন্ত কমিটির অধিকাংশ খরচ বহন করেন চিত্তরঞ্জন দাশ। তিনি তদন্ত কমিটিতে তাঁর প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। যে কারণে হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠ তদন্ত বের করে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছিল।
এছাড়াও তিনি মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার এবং পাঞ্জাবে সরকারি দমননীতির প্রতিবাদে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলেন।

১৯২০ সালে মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের সময় আইনসভা বর্জন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন তিনি। কিন্তু কিছুদিন পর তিনি নিজেই অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব কংগ্রেস অধিবেশনে উত্থাপন করেন এবং গান্ধীজীর ডাকে ব্যারিস্টারি পেশা ত্যাগ করে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। স্বয়ং ভারত সরকার প্রখ্যাত মিউনিশনস বোর্ড ঘটিত মামলায় প্রচলিত নজীর উপেক্ষা করে সাহেব এডভোকেট জেনারেল অপেক্ষা অধিক পারিশ্রমিক দিয়ে তাঁকে সরকারি কৌসুলী নিযুক্ত করেন। অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি এ দায়িত্ব পরিত্যাগ করেন। এই অসামান্য ত্যাগের জন্য ভারতবর্ষের জনগণ কর্তৃক তিনি ‘দেশবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন।

১৯২১ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য তিনি কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ১৯২১ সালে কারাগারে থাকার কারণে আমেদাবাদ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েও উপস্থিত থাকতে পারেননি তিনি। পরের বছর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গয়া কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করেন। কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে সাংগঠনিক বিষয়ে বিরোধ দেখা দেয়ায় তিনি ১৯২২ সালে কংগ্রেসের সভাপতিত্ব ত্যাগ করেন। এরপর তিনি স্বরাজ্য দল গঠন করেন। মতিলাল নেহেরু এবং দেশবন্ধুর নেতৃত্বে এই দল ভারতের অন্যতম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। ১৯১৯-২২ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় বাংলার গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন তিনি।

১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ বাংলার জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেন। বাঙ্গালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক ঐক্যের আহ্বান সমগ্র বাঙ্গালিকেই প্রচণ্ডভাবে নাড়া দেয়। তিনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মুখ্য প্রতিনিধি রূপে আত্মপ্রকাশ করেন এবং হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের লক্ষ্যে ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ নামে ঐতিহাসিক চুক্তি সম্পাদন করেন যা বাংলার হিন্দু-মুসলমান নেতৃবৃন্দের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। এ চুক্তিতে মুসলমান মধ্যবিত্তের অনগ্রসরতা দূর করার বিশদ পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত হয়। সম্ভবত এ চুক্তির কারণেই ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত আইন সভা নির্বাচনে চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বাধীন নবগঠিত রাজনৈতিক দল স্বরাজ্য বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। আর বিজয়ী আইনসভা সদস্যদের মধ্যে হিন্দু ও মুসলমান সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় সমান সমান। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় রাজনীতিতে স্বরাজ্য দল তখন একটি প্রকৃত অসাম্প্রদায়িক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯২৩ সালের নির্বাচনে স্বরাজ্য দল বিশেষ সাফল্য লাভ করে। চিত্তরঞ্জন দাশ ছিলেন কলকাতা করপোরেশনের প্রথম মেয়র।

১৯২৪ সালে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন দমানোর জন্য ব্রিটিশ সরকার ‘১ নং বেঙ্গল অর্ডিনান্স’নামে এক জরুরি আইন পাশ করে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল-রাজনৈতিক কারজকলাপের জন্য সন্দেহভাজনদের বিনা বিচারে আটক রাখা। ওই সময় কলকাতা থেকে সুভাষ চন্দ্র বসু, সুরেন্দ্রমোহনসহ প্রথম সারির নেতাদের গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার। তখন চিত্তরঞ্জন দাশ নিজ বাড়িতে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বৈঠকের আহ্বান করেন। গান্ধীজী উপলব্ধি করেন স্বরাজ্য দলকে দমনের জন্যেই এই অর্ডিন্যান্স পাশ করা হয়েছে। এরপর থেকে গান্ধীজী দেশবন্ধুকে অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। চিত্তরঞ্জন দাশ ১৯২৪ ও ১৯২৫ সালে পরপর দুবার মেয়র নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি চাকরির ক্ষেত্রে অবহেলিত মুসলমানদের অধিক হারে সুযোগদানের নীতি গ্রহণ করেন।

১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘মালঞ্চ’। এই কাব্যগ্রন্থে চিত্তরঞ্জন লিখেছেন ‘ঈশ্বর’ও ‘বারোবিলাসিনী’ নামে দুটি ব্যতিক্রমী কবিতা। নানা বিশেষণও জুটেছিল। অন্যদিকে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়লেন তিনি। বিভিন্ন অসম্মান নীরবে সহ্য করে লড়াই করেছেন দারিদ্র্যের সঙ্গে। লড়াই করেছেন দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনেও। দেশকে স্বাধীন করার লড়াই ছিল তখন প্রধান। ওই সময় বাংলা উত্তাল হয়ে উঠে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তাঁর গান ও রাখীবন্ধন উৎসব নিয়ে সামনে এসেছেন। ওই সময় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও বক্তৃতা করছেন। ওইসব সভায় বক্তৃতা করেছেন চিত্তরঞ্জন। ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে ডাকা হয় এক ঐতিহাসিক সভা। সেখানে লোকমান্য তিলক, লালা লাজপত রায়, মদনমোহন মালব্য, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অরবিন্দ ঘোষের সঙ্গে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। ওই সভা থেকে ডাক দেওয়া হয় স্বদেশি ও বয়কট আন্দোলনের। ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র উচ্চারণে ঝাঁপিয়ে পড়ল বাংলা। চিত্তরঞ্জন দাশ জাতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেন। আবার অরবিন্দ ঘোষের নেতৃত্বে ওই সময়ে গড়ে উঠছে সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের রূপরেখা। ওই সময় প্রমথনাথ মিত্র ও অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের সঙ্গে ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ ‘অনুশীলন সমিতি’গঠনে। কিংসফোর্ড সাহেবের উপর মুজফ্ফরপুরে বোমা মারা হয়েছিল ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল। দুই বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী যুক্ত ছিলেন। প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেন এবং ক্ষুদিরাম বসু গ্রেফতার হয়েছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯১৩ সালের ১৪ মে বাবার সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে চিত্তরঞ্জন মুক্ত হয়েছিলেন। ১৯১৪ সালে তিনি ‘নারায়ণ’ পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। ওই সময় চিত্তরঞ্জনের ৫টি কবিতার বইও প্রকাশ পায়। তাঁর মন্তব্য, এই সমগ্র জীবনের অনুভূতিই সাহিত্য এবং তার জীবন্ত জ্বলন্ত প্রকাশই শ্রেষ্ঠ শিল্পকলা, সেই অনুভূতিই সাহিত্যের রস। চিত্তরঞ্জন দাশের সাহিত্য প্রতিভা নিয়ে আলোচনা বর্তমান সময়ে আর হয় না। মৃত্যুহীন প্রাণ আজও অমর হয়ে বিরাজিত।