বালিশ – নন্দিতা দত্ত

বালিশ   (ছোটোগল্প)

নন্দিতা দত্ত

— আন্টি আপনাকে দেখতে যে প্রতিদিন আসেন, উনি কি আঙ্কেল?
— হ্যাঁ মা, বুড়ো মানুষ কিছুতেই কথা শুনবে না রোজ আসবে। আমার তো একটাই মেয়ে বিদেশে থাকে, একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়। ও ছুটি পেয়েছে। তিন চারদিন পরে আসবে। বাবা তো মেয়ের কথা শোনে না, রোজ আসবেই। ওই দেখো বলতে বলতেই এসে হাজির। ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌

পাশাপাশি দুটি বেডে অসমবয়সী দুজন রোগী। রিমি খুব একটা কথা বলে না। মিসেস সেন নিজে থেকেই শুয়ে শুয়ে কথা বলেন। রিমি বলে কম, শোনে বেশি।
মিসেস সেন রিমিকে অনেক কথাই বলছিলেন। রিমি কি বলবে ভেবে না পেয়ে ঐ একটি কথা বলাতে মিসেস সেনের উৎসাহ দ্বিগুণ হয়ে যায়।

প্রৌঢ় মানুষটির দৃষ্টি মিসেস সেনের দিকে — রিমি অবাক হয়ে দেখে। আর একটু এগিয়ে মিসেস সেনের কপালে হাত রেখে তিনি বলেন, বাহ তোমায় তো খুব খুশি খুশি লাগছে। আজ আর ব্যথা নেই মনে হচ্ছে।
— বসো। সরলা আজ কি রান্না করলো? খাচ্ছো তো ঠিকঠাক?
— আচ্ছা আগে আমার কথার জবাব দাও। আমি তো ঠিক আছি।
— এই যে হাসপাতালের বিছানায় শুয়েও তোমার ভাবনা। আমায় নিয়ে এত চিন্তা করো না।

দুজনে নানা কথায় মগ্ন হয়ে যায়। রিমির উপস্হিতি যেন দুজনেই ভুলে গেছেন। রিমি আঙুলের ফাঁকে ধরে রাখা বইটাকে আবার মেলে ধরে। বইয়ের অক্ষরগুলো ঝাপসা হয়ে আসে।

ভ্রূ পল্লবে ডাক দিলে, দেখা হবে চন্দনের বনে-
সুগন্ধের সঙ্গ পাবো দ্বিপ্রহরে বিজন ছায়ায়
আহা কি শীতল স্পর্শ হৃদয়-ললাটে, আহা, চন্দন, চন্দন
দৃষ্টিতে কী শান্তি দিলে, চন্দন
আমি বসে থাকব দীর্ঘ নিরালায়!

এই কবিতাটা জীবনকে জুড়েছিল, এই কবিতাটা জীবনকে ছিন্নভিন্ন করেছে।


বাহ দারুণ তো। টাকা পয়সা সুদ লোন হিসাবের চাকরি করেন, অথচ সুনীল এতটা জড়িয়ে আছেন, বলেই রিমি যেন লজ্জা পায়। অনির্বাণ জবাব দেয়না মিটিমিটি হাসে। রিমি প্রথম ঘন্টাতেই ক্লিন বোল্ড। বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে।
গত দু’দিন ধরে অ্যানুয়েল ডে’র প্রোগ্রাম নিয়ে বেশ মেতে উঠেছে অফিসের সবাই।

রিমি দু’মাস হলো জয়েন করেছে। এখনও সবার সঙ্গে সেভাবে পরিচিত হয়নি। বাড়ি থেকে অনেক দূরে ত্রিপুরায় এসেছে রিমি চাকরিটা পেয়ে। ব্যাংকিং ক্ষেত্রে অগ্রণী ব্যাংকে রিমি সরাসরি প্রবেশনারি অফিসার হিসেবেই জয়েন করেছে। জায়গাটা উত্তর ত্রিপুরার আধা শহর, আধা মফস্‌সল। দুটো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক কিছু সরকারি দপ্তর আর কিছু দোকানপাট, এক কিলোমিটারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ন্যাশানাল হাইওয়ে, সারাদিন ট্রাক লরি বাসের পাশাপাশি বিভিন্ন মডেলের গাড়ি দেখা যায়। বাইকের ব্যবহার বেশ নজরে আসে। ব্যাংক থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ রিমির ভাড়া-বাড়ি। হোষ্টেল টাইপের বাড়িটায় নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেই বিচ্ছিন্ন দ্বীপবাসী জীবন। রিমি কলকাতার মেয়ে হয়ে এমন জায়গায় নিস্তরঙ্গ জীবনে মানিয়ে নিতে পারবে না ভেবে রিমির মা নিশ্চিত ছিলেন, দুদিনের শখ মিটে গেলেই চাকরি ছেড়ে ফিরে আসবে। মায়ের অমূলক আশঙ্কাকে তুড়ি মেরে রিমি দু’মাস ধরে চাকরি করে যাচ্ছে। ঝকঝকে কথাবার্তা চৌকশ চলাফেরায় এই আধা গঞ্জের শহরে ব্যাংক দিদিমণির পরিচিতি গড়ে উঠেছে।

এই ব্রাঞ্চে একমাত্র মহিলা অফিসার রিমি। অনির্বাণ দিন সাতেক হলো জয়েন করেছে। দুজনের হ্যালো হাই সম্পর্কের বেশি কথা হয়নি।

অ্যনুয়েল ডে’র প্রোগ্রাম খুব ছোট ঘরোয়া ভাবেই এই ব্যাংকের কাষ্টমার দের কথা ভেবেই এরেঞ্জ করা হয়। রিমির খুব কলেজে দিনগুলোর কথা মনে পড়ছিল। মিস করছিল সেই সব বন্ধুদের যাদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারটিসিপেট করত।

অনির্বাণ আগরতলার হেডঅফিস থেকে বদলি হয়ে এসে ধাতস্থ হওয়ার আগেই অ্যানুয়েল প্রোগ্রামের তোড়জোড়ের মধ্যে পড়ে যায়।

দ্বিতীয় শনিবার ছুটির দিনে সবাই জড়ো হয়েছে, প্রোগ্রামটা কিভাবে করা হবে তা নিয়ে আলোচনার জন্য। এই ব্রাঞ্চের সতের জন ষ্টাফের মধ্যে ম্যানেজার ইব্রাহিম আব্বাসের চাকরি আর কয়েকমাস। তার ইচ্ছে অনুযায়ী এবার অ্যানুয়েল ডে শুধু ক্লায়েন্ট ডে নয় একটু অন্যরকম।
রিমির কথার সূত্র ধরেই ইব্রাহিম অনির্বাণকে চেপে ধরে।
ভ্রূ পল্লবে ডাক দিলে ক্লায়েন্ট আসবে না ঠিকই কিন্তু আমরা চাঙ্গা হয়ে যাবো। অনির্বাণকে সরাসরি ম্যানেজার বলে, এবার ভ্রূপল্লবে ইশারায় কে সঙ্গী হয় দেখবো। অনির্বাণ মুচকি হাসে।
বিশ্বাসবাবু টাকা গুনতে গুনতে “সে গুণ আমার নাই গো যে গুণে বন্ধু রে পাবো” এই লাইন গুনগুন করেন। তিনি হেসে বলেন একটা দারুণ গুণ আছে অনির্বাণের, এবার জানলাম। বন্ধু হাত বাড়াবেই‌।
সুজিত, অনুপম, অসীম, শিশির, ঊষারঞ্জন, পিটার, শ্যামলাল সবাই মিলে হৈ হৈ শুরু করে দেয়। আধঘন্টার একটা ছোট গানবাজনার আসরে বিশ্বাসবাবু লোকগান গাইবেন, অনির্বাণ কবিতাপাঠ করবে, জোকস বলবে শিশির, উষারঞ্জন অসীম বাংলা আধুনিক আর সিনেমার গান গাইবে। রিমি ব্যাংকিং পরিসেবা আর নতুন স্কিম নিয়ে কথা বলবে। আধঘন্টার অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় তিনঘন্টা সময় খরচ করে বাড়ির দিকে পা বাড়াতেই অনির্বাণ পাশে এসে বলে, বাড়ি যাবেন তো চলুন হাঁটি। রিমি সম্মতি সূচক ঘাড় দোলাতেই অনির্বাণকে আর পায় কে।

— চলুন সামনের ওই ষ্টলটায় চা খাই।
— আপত্তি নেই। চলুন।
চা খেতে গিয়ে কে চায়ের দাম দেবে তা নিয়ে একপ্রস্থ লড়াই।
— কেন আপনি চায়ের দাম দেবেন?
— আমি আপনাকে চা খেতে ডেকেছি তাই।
— আমারও ইচ্ছে ছিল।
— ইচ্ছে থাকলেও তো আসেননি, আমি বলাতেই এলেন।
— আচ্ছা ঠিক আছে, নিজেকে নিজে চা খাওয়াচ্ছি। আমিও আপনাকে খাওয়াবো না। আপনিও আমাকে না।
— আচ্ছা মানুষ তো আপনি। আমি আমার জীবনে এমন লোক দেখিনি।
— এবার দেখলেন তো বলেই রিমি মুখ না ঘুরিয়েই বুঝতে পারে অনির্বাণ বোল্ড হয়ে গেছে।
রিমি দশ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আমি আসছি। অনির্বাণ কিছু বলার আগেই রিমি হাঁটতে থাকে।

দিন দশেক পর।
— রিমি এই একাউন্টটার কিছু প্রোবলেম আছে। দেখে একটু উনাকে কি করতে হবে বলে দিও।
একাউন্টের সমস্যা সমাধানের মধ্য দিয়ে অনির্বাণ রিমির বন্ধুত্ব প্রেম গড়ে ওঠে।

অনির্বাণ এর বাবা-মা শিক্ষকজীবন শেষে উদয়পুরে থাকেন নিজেদের বাড়িতেই। ছোটবোন আইন নিয়ে পড়াশুনা শেষ করে ব্যাঙ্গালোরে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে। বাবা মা বিয়ের কথা বললে অনির্বাণ এড়িয়ে যায়। প্রতি বছর শখে ট্রেকিং-এ যায়। একটা ট্রেকিং ক্লাবের মেম্বার।

দিন তো ভালোই কাটছিল। তুমি তো সব গণ্ডগোল করে দিলে।

কি বলে লোকটা? এই মশাই আমি কি গণ্ডগোল করলাম। তুমিই তো ভ্রূ পল্লবে ডাক দিয়ে চন্দনের বন দেখালে, তারপর সব গণ্ডগোল হয়ে গেল। এই এবার আমায় নেবে তোমার সাথে ট্রেকিং এ?
— যাবে? পারবে তো?
— কেন তোমার কি আমায় পুতু‌পুতু মনে হয়!
— না তা বলিনি, তবে আচ্ছা যেও। দেরি আছে তো অনেক।

অফিস শেষে কোন কোন দিন রিমির বাড়িতে যায় অনির্বাণ।
দুজনে কোন ছুটির দিনে সকালের ট্রেনে আগরতলা এসে আবার বিকেলের ট্রেনে ফিরে যায়। উদয়পুর বাড়িতে মা বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। রিমিকে দেখে অনির্বাণের মা ভাবে, ছেলে এবার বিয়ে করবে।
রিমিকে খুঁটিয়ে জেনে নেয়, বাড়িতে কে কে আছে? বাবা মা কি তোমার কাছে এসে থাকেন ?
আন্টি আমার বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে, আমি স্কুলে পড়ার সময়। মা একটা ওষুধের কোম্পানিতে কাজ করেন। বাবার সাথে আমাদের যোগাযোগ নেই। ঠাকুমা দাদুর সাথে মায়ের যোগাযোগ আছে। ঠাকুমা দাদুর তাদের পছন্দের মেয়েকে তাদের ছেলের সাথে বিয়ে করিয়েছিল। বাবা নেভিতে আছেন। বাবার মত করে। শুনেছি তার বাবা মায়ের সাথেও তার যোগাযোগ নেই।
অনির্বাণের মা মফস্‌সলের মানুষ।
মুহূর্তে অনির্বাণের মায়ের চেহারা পাল্টে গেল। ঈশ্বরকে স্মরণ করে একটাই প্রার্থনা করলেন। এই মেয়ের সাথে যেন আমার ছেলের বিয়ে না হয়। প্রথম পরিচয়ের পর ভালোলাগাটা ডিভোর্সড মা-বাবার সন্তান শুনে উড়ে গেল।

ডিভোর্সী মায়ের মেয়ে পছন্দ নয়। অনির্বাণকে সরাসরি না বললেও বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই কথাবার্তার পর রিমি একদিন থাকলেও রিমি নিজের জগতেই ছিল বলে অনির্বাণের মায়ের ব্যবহারের অসংগতি খুব একটা অনুভব করেনি। অনির্বাণ সব বুঝে থম মেরে গেছে।

মাস তিনেক পর অনির্বাণ রিমিকে নিয়ে ট্রেকিং-এ যায়। রিমির পারফরম্যান্স দেখে অনির্বাণ খুশি। সব চাইতে বড় কথা ন্যাকামিহীন প্র্যাকটিক্যাল রিমিকে নতুন করে আবিষ্কার করে অনির্বাণ।

ট্রেকিং থেকে ফেরার পথে রিমি কলকাতায় মায়ের কাছে নিয়ে যায় অনির্বাণকে।

— আমি তো মা-বাবার পছন্দের মানুষটির সাথে থাকতে পারিনি। তুই ওকে বিয়ে করবি তো? অনির্বাণের আড়ালে রিমির মা প্রশ্ন করলে রিমি বলে, ওকে ভালো লাগে, কেয়ারিং। একসাথে থাকতে পারি। তবে বিয়ে করবো না।
রিমির মা অবাক হয় না। শুধু জিজ্ঞেস করে, বিয়ে না করে থাকবি একসাথে এটা কেমন কথা।
— এটাই কথা, ভালো লাগে তাই থাকবো। বিয়ে করতে হবে কেন?
— জানি না তোদের এ ভাবনাগুলো কেন আসে?
— তোমাদের তো বিয়ে হয়েছিল, কদিন থেকেছো একসাথে? তুমি তো সিঙ্গেল মাদার হয়ে আমাকে মানুষ করেছো? তোমার এই বস্তাপচা মানসিকতা কেন?

রিমি জানে মাকে আঘাত দিলে মা চুপ হয়ে যাবে। রিমি সরাসরি এই অস্ত্রেই মাকে ঘায়েল করে অনির্বাণের বুকে মুখ লুকায়।

— কি হয়েছে তোমার?
— কিছু না। একটা কথা বলো আমরা দুজন আলাদা মানুষ তো?
— ঠিক।
— আমাদের ভাবনা চিন্তা কি এক?
— কখনো মেলে কখনো মেলে না।
— এটা কি অস্বাভাবিক?
— নাহ কেন?
— তাহলে একটা কথা আজ জানতে চাইবো আমরা বিয়ে না করে কি একসাথে থাকতে পারিনা?
— এই তো আছি, বিয়ে কি করেছি?
— আরে এখনকার কথা নয়, ফিরে গিয়ে?
— একশবার পারি। আমারও ভালো লাগে না। একটা কাগজে সই বা মালাবদল করে প্রমাণ দিতে হবে আমাদের এক সাথে থাকা বৈধ কিনা।
— একজাক্টলি আমারও তাই মনে হয়। কতগুলো টাকা পয়সা নষ্ট করে সময় নষ্ট করে একরকম ঢ়্যাড়া পেটানোর দরকার কি?
— এই একটা জায়গায় তুমি আমি একবারে একমত। তাহলে এবার ফিরে গিয়ে একসাথে থাকবো।
রিমি খুশিতে অনির্বাণকে কয়েক সেকেন্ড জড়িয়ে থাকে।

রিমির মা অফিস যায়নি। দুপুরের ফ্লাইটে রিমি ওরা আগরতলা ফিরবে। মেয়ের পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করলেও মুখ থমথমে। মেয়ে যে ধরনের জেদি, কিছু বললে হয়তো না খেয়েই বেরিয়ে যাবে। তাই কথা না বাড়িয়ে দুজনকে খেতে দিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোর তো তিন বছর ওখানে হয়ে গেল, ট্রান্সফারের কি কিছু হলো?
— না তেমন ভাবিনি। আমার কাছে কাশ্মীর যা কোচিও তাই। নিজেকে নিয়ে ভালো আছি। সেট হয়ে আছি। ভালো না লাগলেও ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু ভাববো।
অনির্বাণ চুপ করে মা-মেয়ের কথা শুনতে শুনতে খাচ্ছিল।
রিমির মা হঠাৎই জিজ্ঞেস করে, অনির্বাণ তুমি কি ওখানেই থাকবে?
— আন্টি আমি ভাবিনি। তবে আমি ব্যাঙ্কিং সেকটর ছাড়বো না। রিমি একবার কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। না এখন গল্প করলে দেরি হয়ে যাবে। আমি উঠছি বলে বেশ শব্দ করে চেয়ারটা ঠেলে দাঁড়ায়।
— রিমি দায়িত্ব এড়ানোর সহজ পন্হা হলো ইগনোর করা। এটা তোর মধ্যে এখন আরো বেড়েছে।
— আচ্ছা মা অনেক তো দায়িত্ব নিয়েছো, কিন্ত তুমি আজীবন একা। ওসব কথা বাদ দাও।
অনির্বাণ চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করে। মা আন্টিরা সব একরকমের ভাবনা ভাবে। আমার মাকে ব্যাকডেটেড ভাবতাম উনিও দেখি তাই। বড় শহরে থাকেন কিন্তু মনটা বড় হয়নি।

কলকাতা থেকে সময় মত ফ্লাইট আগরতলায় আসায় রাতের ট্রেন ধরে ষ্টেশানেই রিমি অনির্বাণকে বলে, চল আজ থেকেই একসাথে থাকি।
— না আজ বাদ দিচ্ছি। বাড়ি যাব পরশু। তারপর ভাড়া বাড়ি ছাড়তে হবে। সামনের মাস থেকেই থাকি।
রিমি একাই নিজের আস্তানায় ফিরে মাকে ফোন করে জানায় ঘরে পৌঁছে গেছে।

— এই মেয়ে তোমার কি নাম ?
রিমি চোখ খুলে দেখে অসম্ভব মায়া ভরা চোখ নিয়ে যে প্রশ্ন করছেন, তিনি ওই প্রৌঢ় ভদ্রলোক। তিনি নিয়ম করে তার স্ত্রীকে দেখতে আসেন। রিমি ম্লান হেসে বলে, রিমি। উঠে বসার চেষ্টা করতেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন আমি কি হেল্প করবো?
— না না আমি পারবো।
তিনি জানেন এই প্রজন্ম অত্যন্ত আত্মমর্যাদা সম্পন্ন। তাই তিনি কিছু বলেন না।
— আপনি বসুন। পাশের চেয়ারটা দেখিয়ে রিমি বলে।
— আচ্ছা তোমার কি হয়েছে জানতে পারি কি?
— আমার খুব সম্ভব অ্যাপেনডিকসের প্রোবলেম। আজ তো ডাক্তারবাবু আসেননি, এলে জানতে পারবো।
— তা তোমার বাড়ি কোথায়? তুমি কি এখানে চাকরি করো?
— আমার বাড়ি নেই। জন্ম পড়াশুনা কলকাতাতে। চাকরিসুত্রে উত্তর ত্রিপুরায় থাকি। ব্যাঙ্কে কাজ করি। ব্যথা হচ্ছিল তাই নিজেই আগরতলায় চলে আসি এই হাসপাতালে। ওরা এডমিট করিয়ে নেয়। দেখি রিপোর্ট কি আসে।
— বাবা মাকে জানিয়েছো? রিমি প্রশ্নটা এড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, উনি তো এখন ভালো। কি হয়েছে উনার? জেনেও জিজ্ঞেস করে।
— এই বয়সে যা হয়, হাঁটু ব্যথায় খুব কষ্ট পায়। তাই মাঝে মাঝে রিলিফ পেতে ভর্তি হতে হয়। তবে কাল ছেড়ে দেবে। জানো কত কথা বলি আমরা সারাদিন। চা খাই গল্প করতে করতে অনেক বার। আমাদের খুব ভালো সময় কাটে। ও বাড়িতে না থাকলে খুব ফাঁকা লাগে। আমাদের ৫৭ বছরের দাম্পত্য। কতদিন ঝগড়া হয়। কিন্তু এই হাসপাতাল ছাড়া ও কখনো একা থাকতে পারে না। আমিও পারি না। বলেই হো হো করে হেসে উঠলেন তিনি।
— তোমার কি কোন সঙ্গী নেই, বিয়ে করোনি মনে হচ্ছে।
— এই যে মাসিমা খুব খুশি। কাল বাড়ি যাচ্ছেন। ডাক্তারবাবুর কথা শুনেই ফিরে তাকায় প্রৌঢ়।
প্রৌঢ় আবার রিমিকে বলেন, আচ্ছা ভালো হয়ে যাবে দেখো। অনিয়ম করো বোধহয়। শরীর কিন্তু মেশিন। যত্ন করতে হয়। ভালো করে খাবে। আনন্দে থাকবে। আমি ওদিকে দেখি ডাক্তারবাবু কি বলেন।
রিমি মাথা হেলায়। আবার চোখ বন্ধ করে। দু’চোখ বেয়ে জল গড়ায়।

— রিমি এটাই তোর শেষকথা। বিয়ে করতে আপত্তি কেন? দুজন দুজনকে ভালোবাসিস। দুজনেই ভালো রোজগার করিস। বিয়ে করে স্বাভাবিক জীবনে থাক। আমার পক্ষে মানা সম্ভব নয়।
— অনির্বাণ তুমি ভাবতে পারবে না কি কঠিন গলায় কথা বললো মা। আমি আমার মাকে চিনতে পারলাম না। আমার অবাক লাগছে।
— অবাক হয়ো না। আমার বাবা মা বোন সবার এক কথা — বিয়ে ছাড়া ওরা ভাবতেই পারছে না। রিমি ওদের ভাবনায় বিয়েটা সব। — শোনো আমরা দুজন একমত তখন আমাদের কাউকে লাগবে না। দুজনেই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে নতুন বাড়িতে ভাড়া যাবো। কেউ প্রশ্ন করবে না।
— হ্যাঁ কাল একটা বাড়ি দেখতে যাবো। ব্রিজের ঐ পারে। সুন্দর ফ্ল্যাট।

মাস তিনেক হলো দুজনে এক সাথে থাকে। এই ফ্ল্যাটটা জন দেববর্মার। তিনি ফ্যামিলি নিয়ে দিল্লিতে থাকেন। বাড়িওয়ালা  অনির্বাণ রিমি লিভ টুগেদার করে জেনেই ভাড়া দিয়েছেন, কোন সমস্যা হয়নি। পুরো এলাকায় এই নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। তিনমাসের মধ্যে একবার সাতদিনের ছুটি নিয়ে ইন্দোনেশিয়া ঘুরে এসেছে। দুজনের ঠুকাঠুকি হয়েছে আবার নিজেরা মিটিয়ে নিয়েছে। তিন মাসের মধ্যে দুজনেই দুবার করে বাড়িতে ফোন করেছে। কেউ ফোন ধরেনি। ওরা নিজেরা দুজন মেনে নিয়েছে। মন খারাপ হলেও দুজন দুজনের মন খারাপ আড়াল রাখে। এরমধ্যে দুজনের দু’জায়গায় বদলির অর্ডার এসেছে। মেইন ব্রাঞ্চে কথা বলে দুই বছর এই ব্রাঞ্চে থাকার পারমিশন করে ‌নিয়েছে।

— এই, বেশ ভালো হতো দুজন দু’জায়গায় থাকলে।
— কেন অনির্বাণ, একথা কেন বলছো?
— আরে আমার বোকা বউটা বোঝে না। মজা করছিলাম।
— কোনটা মজা? আর আমি একসাথে থাকি বলে কি বউ তোমার?
— এই কি হয়েছে তুমি আমার বউ না!
— বউ ? না তো, কোথাও আমরা কোন ট্যাবু লাগানো সম্পর্কে নেই। সস্তা সেন্টিমেন্ট দেখিও না।
— আচ্ছা ছাড়ো। সাধারণ মজাটা বোঝোনা।
— আমি কিছু বুঝতে চাইনা।
পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে বুঝে অনির্বাণ কথা বাড়ালো ‌না‌। যান্ত্রিকভাবে যে যার মত ব্যস্ততার ভানে প্রসঙ্গ এড়ালো।

রাতে খাবার টেবিলে ভাত নেড়ে চেড়ে রিমি উঠে গেল। কিছুক্ষণ পর ড্রয়ার খুলে ওষুধ খেলো। চোখ বন্ধ করে শুয়ে অনির্বাণ দেখলো। প্রশ্ন করলো না। রাত ক্রমশ গভীর হলো। এক বালিশের দুটো মাথা আলাদা হয়ে দেওয়ালে আঁকিবুকি কাটলো।

— এই তুমি এখনো ঘুমাচ্ছো, অফিস যাবে না? রিমি পাশ ফিরে শুয়ে কি বললো অনির্বাণ না শুনেই মেজাজ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। রাত আটটায় বাড়ি ফিরে দেখলো রিমি শুয়েই আছে।
— কি হয়েছে তোমার? সারাদিন শুয়েই কাটালে? অফিসে জবাব দেওয়াটা কি আমার দায়িত্ব?
— তুমি আমার বউ না তবু প্রশ্ন আর প্রশ্ন। ফোন অফ‌ করে রেখেছো কেন?
— আমার কি হয়েছে শরীর খারাপ কিনা জানার চেষ্টা করেছো?
— শরীর খারাপ লাগলেও আমায় না বললে জানবো কি করে? আমি কি গণকঠাকুর? ডিসগাষ্টিং।
— আশ্চর্য, আমার শরীর ভালো নেই সেটাও বোঝো না। বুঝবে কি করে? অফিস থেকে ফিরেই তো বোতল খুলে বসো। হুঁশ থাকে কিছু?
— একটা থাপ্পড় মারবো। মুখ সামলে কথা বলো। আমি আমার পয়সায় খাই। তোমার কি?
— এত বড় কথা তুমি বলতে পারলে? তোমার ভ্রূ পল্লবে ডাক শুনে আমি কোন কিছু মানিনি। আর তুমি!
— আচ্ছা তুমি এত ন্যাকা হলে কবে থেকে? তুমি তো অন্যরকম জেনেছিলাম। এখন দেখছি মেয়ে মানেই খবরদারি। খবরদারি ফলাতে এসোনা। তোমার জন্য বাড়ি ঘর ছেড়েছি। দুস, ঘরে ফিরেই ঘ্যানর ঘ্যানর।

অনির্বাণ আবার বেরিয়ে যায়, বাইকের আওয়াজে রিমি বুঝতে পারে। অনেক রাতে ঘরে ফিরে দেখে সোফায় বসে রিমি কিছু লিখছে। পাশে বসে বলে, স্যরি, মাথা গরম হয়ে গেছিল। তোমার কি হয়েছে? মাইগ্রেশনের ব্যথা বেড়েছিল? রিমি পাশ থেকে উঠে চলে যায় ভেতরের ঘরে।

অনির্বাণ খোলা খাতায় কি লেখা দেখার চেষ্টা করে। হিসেব লেখা। কে কি টাকা কনট্রিবিউট করেছে এই তিনমাসে। অনির্বাণ বুঝতে পারেনা হিসেব কোন কর্মে লাগবে। অস্ফুট কিছু বলে। উঠে রান্না ঘরে যায়। রান্নাবান্না কিছুই করেনি। রিমি কি সারাদিন না খেয়েই ছিল। রিমি রিমি তুমি — কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলো। খাটে বসে রিমি হেসে কাউকে ফোনে কিছু বলছিল। অনির্বাণকে দেখে বলে পরে কথা বলবো। অনির্বাণের আবার মেজাজ খারাপ হয়। সেদিন একজন সোফায় আর একজন বেডরুমে কাটায়।
পরদিন সকালে রিমি অনির্বাণের আগে বেরিয়ে যায়। অনির্বাণ ঘুম থেকে উঠে দেখে রিমি নেই।

রিমিকে কাল থেকে কথাটা বলার চেষ্টা করেও বলতে পারেনি। দম বন্ধ‌ লাগছে। রিমিকে না বললে বলার কেউ নেই। কিন্তু রিমি কাল থেকে অন্য জগতে।
কাল স্কুলজীবনের বন্ধু সুকোমল ফোন করে জানিয়েছে বাবা অসুস্থ। অথচ অনির্বাণকে জানায়নি। ভেবেছিল রিমির সাথে কথা বলে আজ সকালেই উদয়পুর যাবে। কিন্তু এমন ঝামেলাতে কিছুই বলতে পারেনি। অথচ সকালে রিমি না বলে বেরিয়ে গেছে। এখানে কারো বাড়ি এমন নেই রিমি যেতে পারে। অনির্বাণ আর কিছু ভাবতে পারছেনা না ।
উদয়পুর যাবে ঠিক করলো। এখানকার কালি মন্দির আসাযাওয়ার পথেই পড়ে। অনেকেই বাইরে থেকে এসেছে। গল্প শুনেছে। কোনদিন ভেতরে যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি। আজ মনটা ভালো নেই। রিমি ছাড়া এ মন্দিরে যাবে ভাবতে ভাবতে গাড়ি জাতীয় সড়ক ধরে ছুটতে থাকে।

অনির্বাণের যে দায়িত্ব একদিন না গেলে তেমন অসুবিধা হয়না। সে ইচ্ছে করেই মাঝে মাঝে কোন কারণ ছাড়া ডুব মারে। রিমিকে দশটার মধ্যে চেয়ারে বসতেই হয়। দিনশেষে ঘরে ফিরে দেখে, কয়েকটা খালি চায়ের কাপ, এসট্রে ভর্তি পোড়া সিগারেট আর একটা কবিতার বই ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। রিমি বোঝে আজ অনির্বাণ রিমিকে কবিতায় আর আদরে ভাসাবে। রিমিও বেড়ালের মত আদরটা খায়।

ফোন না করেই অনির্বাণ এখন উদয়পুরের পথে। মাথায় চিন্তা। তবুও কি মনে করে ম্যানেজারকে মোবাইল থেকে একটা মেইল ড্রপ করে দিল।
রিমির ফোন নট রিচেব্যল থেকে এখন এনগেজড।
যতবার ফোন করছে এনগেজড আসছে নাহ আর নয়। ভাবলো জরুরি কোন কলে কথা বলছে, রিং ব্যাক করবে। সারা রাস্তায় কোন কল এলো না রিমির। আগরতলা পৌঁছে রিং করে ফোন অফ পেল।
ভাবলো যাকগে দরকার মনে করলে রিমি ফোন করবে। রিমি বলেছে বৌ না। সুতরাং কোন কথা বলতেও পারেনা। হঠাৎ সুকোমলের ফোন, অনির্বাণ শোন, স্যার কে নিয়ে উদয়পুর হাসপাতালে এসেছি। স্যারের প্রেসার খুব বেড়ে গেছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
— আমার হয়তো চল্লিশ মিনিট লাগবে। যা দরকার তুই কর। টাকা পয়সার চিন্তা করিসনি।

অনির্বাণের খুব অস্হির অস্হির লাগছে। বাবা খুব চাপা মানুষ। বোনের সাথেও যোগাযোগ নেই। ভাবলো বোনকে ফোন করে জানাবে। তারপর সিদ্ধান্ত নিল, হাসপাতালে পৌঁছে অবস্থা বুঝে ফোন করবো।
অনির্বাণ উদয়পুরের কাছাকাছি পৌঁছতেই সুকোমলের আবার ফোন, আগরতলা রেফার করেছে।
উদয়পুর হাসপাতালে পৌঁছতেই দেখলো অ্যাম্বুলেন্সটা ছুটছে। সুকোমলকে ফোন করে বলল, পেছনে আমি আছি। মা কোথায় সুকোমল?
— মাসিমা সাথেই আছেন।
কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়ে বোনকে ফোন করলো। অনেকদিন পর। ধরবে তো! দুতিনবার রিং করার পর অন্য প্রান্ত হ্যালো বলতেই বলল, কাটিস না ফোন। বাবা অসুস্থ, অ্যাম্বুল্যান্সে আগরতলা নিয়ে যাচ্ছি।
— কি হয়েছে বাবার?
— জানি না। তুই সবচেয়ে তাড়াতাড়ি যেদিন আসতে পারবি চলে আয়।

এবার আবার অনির্বাণ রিমিকে ফোন করে। ফোন বন্ধ। এবার একটু ঘাবড়ে যায়। ভাবে অফিসে ফোন করে কাউকে বলবে রিমিকে ডেকে দিতে। অসীমকে ফোন করতেই অসীম বলে, কি ব্য্যাপার দুজনে একসাথে কোথায় ডুব মারলে? .মানে রিমি অফিস যায়নি? আমি তো সকালে স্যারকে মেল করে উদয়পুর এসেছি। বাবার খুব শরীর খারাপ আগরতলা রেফার করেছে।। আমি রিমিকে ফোনে পাচ্ছি না। আচ্ছা তুমি একটু ফোনে পেলে জানিও।

— আজ যে তুমি এত সকাল সকাল, হোমের মাদার রিমিকে প্রশ্ন করে।
রিমি মাঝে মাঝে এই হোমটাতে আসে। ছোট হোম। মিশনারীদের। ১০ টা অনাথ বাচ্চা থাকে। রিমি বাচ্চাদের জন্য বিস্কুট, আপেল, মিষ্টি আর কেক নিয়ে এসেছে। মায়ের জন্মদিনটা হোমে আসে প্রতিবছর। তিনবছর আগে প্রতিবছর মাকে ফোনে উইশ করতো। এখন তো মায়ের সাথে কোন যোগাযোগ নেই। কেমন আছে সেটাও জানার সুযোগ নেই।
— কি হয়েছে মন খারাপ কেন? মাদার মায়াভরা গলায় জিজ্ঞেস করতেই রিমি এড়িয়ে যায়। বলে, আমি এবার দুদিন থাকবো। তার আগে ফোনে চার্জ দিতে হবে।
ফোনটা চার্জ দশ পার্সেন্ট হতেই অনির্বাণকে ফোন করে। ফোন বেজে যায়।

অ্যাম্বুলেন্স থেকে বাবাকে নামিয়ে স্ট্রেচারে তুলতে গিয়ে অনির্বাণের ভয় হয়। ইমারজেন্সিতে নিয়ে যেতেই ডাক্তার নানা ভাবে পরীক্ষা করে বলে, স্যরি, দেরি করে ফেলেছেন। মা এতক্ষণ চুপ ছিল। হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে বলতে থাকেন তোর জন্যই এমন হলো। তিনটা বছর ধরে লোকটা পাথর হয়ে ছিল। তুই কত বড় আঘাত দিয়েছিস। মানুষটি শেষ হয়ে গেল। আরোও কি বলছিল অনির্বাণ শুনতে পেলনা।

প্রায় দু ঘন্টা পর সব ফর্মালিটি সেরে উদয়পুর বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে হবে বাবাকে। গাড়িতে নিথর বাবার শরীরটাকে আগলে মা। অনির্বাণকে যেন ছুঁতে দেবেনা। অনির্বাণ চোখের জল আড়াল করতে জানালায় চোখ ফেরায়।
— তোমার যাওয়ার দরকার নেই, মায়ের কথাটা গলানো সিসার মত কানে ঢুকতেই মাথা নিচু করে চুপ হয়ে গেলেও উদয়পুর যাচ্ছে বাড়িতে এটাই সত্য।

হোমে সারাটা দিন বাচ্চাদের পড়িয়ে গল্প করে দিন কেটে গেলেও রাত হতে থাকলে নিজেকে রিমির খুব অসহায় লাগছিল। এতদিন ভালোবেসে অনির্বাণের সাথে কাটিয়েছে। ঝগড়া, মারামারি করলেও রাতে দুটো মাথা একটা বালিশেই আশ্রয় নিত। অনির্বাণ পাল্টে গেছে এতটা। সারাদিন পেট ব্যথায় ঘরে কাটালো অথচ ফোন তো দূরের কথা রাতে বাড়ি ফিরে সিন ক্রিয়েট করলো। কদিন আগে অনির্বাণ একবার বলেছে আমাদের তো কোন বন্ধন নেই। যেদিন পোষাবে না আলাদা থাকবো। রিমি চুলে বিলি কেটে বলেছিল শাকচুন্নি হয়েও তোমার সাথে থাকবো।
এভাবে পাল্টে গেল অনির্বাণ!
এই হোমের বাচ্চাগুলো তো অনাথ নয় ওদের তো মাদার সহ অনেকেই আছে, রিমির মনে হচ্ছে তার মতো অনাথ কেউ নেই। কাল অফিস গিয়ে একমাসের লম্বা ছুটি নিয়ে মায়ের কাছে যাবে। মায়ের কোলে মাথা রেখে ঘুমাবে। মায়ের হাতে মাখা ভাত খাবে। তারপর অনির্বাণকে সিদ্ধান্ত জানাবে আর একসাথে থাকা নয়। যে যার মতো স্বাধীন জীবনে ফিরে যাবে।
কিন্তু বুকের ভেতর এমন কষ্ট হচ্ছে কেন? খুব কান্না পাচ্ছে।

বাবার শরীর এখন ডেডবডি। অনির্বাণ মাকে জড়িয়ে বসে আছে। গাড়ি ছুটছে। সুকোমল পিছনের দিকে তাকিয়ে বললো, আমি ক্লাবে ফোন করে জানিয়ে দিই, মাষ্টারমশাইকে নিয়ে আসছি। ওরা যেন সব ব্যবস্থা করে রাখে।
অনির্বাণ একটা লিভ এপ্লিকেশন লিখে মেইল করে দেয়।
রিমির কথা মনে হলেও আর ফোন করেনা।

— তুমি এত কাঁপছো। শীত লাগছে? দেখি, ওবাবা তোমার গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। একটা ক্যালপল দিচ্ছি।
সারারাত হোমের মাদার আর সিস্টার মিলে জেগে রইলো। জ্বর কখনো একটু কমলেই আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই বেড়ে যাচ্ছে। সকাল হতেই মাদার ডিশিশান নিলো হাসপাতালে নিতে হবে। ধর্মনগর হাসপাতালে নিয়ে এলে রিমিকে চেকআপ করে ডাক্তার আগরতলায় রেফার করলো।
রিমি মাদারকে একটা মেইল আইডি দিয়ে বললো, ম্যানেজারকে অসুস্থ জানিয়ে দিতে।
মাদার বা সিস্টার কারোর পক্ষে আগরতলায় আসা সম্ভব নয়। রিমিকে অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে দিল। রিমির ফোনে পিডিএফ করা সব কাগজপত্র আছে। এটিএম কার্ড সাথে আছে।

অনির্বাণ আর রিমি দুজনেই অভিমানে অহংবোধে যোগাযোগহীন হয়ে পড়লো।

রিমি ভালো তো তোমায় বেসেছিলাম। তোমায় ভালোবেসে বাবা মায়ের আপত্তি সত্ত্বেও তাদের সাথে যোগাযোগ বিহীন জীবন বেছে নিয়েছিলাম। কিন্তু এ জীবনটা কি হয়ে গেল! বাবাকে হারালাম। রিমি তুমি অফিস যাওনি। আমায় না জানিয়ে তুমি কি কলকাতা গেলে? তোমার মায়ের সাথে তো তোমার যোগাযোগ নেই।
এসব আমি কেন ভাববো? না আমি ভাববো না। সত্যি তো আমরা তো কোন সম্পর্কের বাঁধনে নেই।

প্রায় ছয় ঘন্টা জার্নি শেষে আগরতলায় বেসরকারি হাসপাতালে পৌঁছলে মাদারের ব্যবস্থা মতো, রিমিকে ইর্মাজেন্সিতে ষ্টেচার করে নিয়ে আসা হয়। রিমি অচৈতন্য।
জ্ঞান ফেরার পর থেকে ডাবল বেডের এই কেবিনে।
পরীক্ষা নিরীক্ষার সব রিপোর্ট এলে জানা যাবে কি হয়েছে।
তিনদিন হয়ে গেল, রিমিও জানেনা অনির্বাণ কোথায়।
রিমি চোখ মেললেই দেখেছে ডাবল বেডের এই কেবিনে সাদা চুলের সিঁদুর লাল সিঁথির প্রৌঢ়াকে। সকাল বিকাল প্রৌঢ়কে। গল্প শুনেছে ৫৭ বছরের দাম্পত্যের।
দু-একবার সিঁথিতে সিঁদুর পড়তে ইচ্ছে হলেও নিজেকে নিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছে। সিঁদুর ছাড়া সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখা যায় ভেবেছে। সমাজকে তুড়ি মেরে বিবাহহীন একসাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে কি ঠকে গেছে না ভুল করেছে।
প্রৌঢ়া আগামী কাল বাড়ি যাবেন। মোড়া পেতে রোদে বসে গল্প করবেন দুজনে। আচ্ছা ওদের জীবনে চন্দনের বন সুগন্ধ ছড়ায় এত বছর পরেও। সেকি উনাদের বিবাহিত জীবনের কারণে কি?
রিমি নিজেকে জিজ্ঞেস করে। আবার ভাবে ভুল। ভাবতেই রিমির অনির্বাণের কথা মনে হয়। এত স্বার্থপর তুমি। একবারও খোঁজ নিলে না। অথচ দুজনেই ভেবেছিলাম একসাথে বুড়ো হবো। যতই ঝগড়া করি মারামারি করি মাঝরাতে এক বালিশেই মাথা থাকবে। হাসপাতালের বেডের এই বালিশটায় একটাই মাথা। চোখ দুটো অন্য মাথাটা খোঁজে কোনদিন এক হবে না জেনেও।