আঁখিতে রাখি মন – কামরুল হাসান

আঁখিতে রাখি মন

কামরুল হাসান

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘নামের মতো সবসময় হয় না মানুষটি’। কবিগুরু তাঁর ‘ইচ্ছাপূরণ’ গল্পে এই কথাটি বলেছেন, নামের সাথে পিতা-পুত্রের স্বাস্থ্যগত এবং স্বভাবগত অমিল দেখে। কবিগুরুর এই কথাটি চেহারার বেলাতেও খাটে। যেমন, কারও নাম বুচি আসলে নাক তার উঁচু। এই যেমন আমার প্রতিবেশীর নাম কালা, আসলে গায়ের রং তার ধলা। আমার এই গল্পেও ঘটেছে এমনটা। নামের সাথে মানুষটির মিল নেই সামান্যতম।

হ্যাঁ, নাম তার নিশিথীনি। নিশিথীনি শব্দের অর্থ রাত। আর রাত মানেই আলোহীন, অন্ধকার। প্রকৃতপক্ষে নিশিথীনির আপাদমস্তক অন্ধকারের ছোঁয়া নেই এতটুকু। নিশিথীনি দেখতে দীপ্তিময়, আলোকময়। হবে হয়তো এ ধরায় আগমন তার কোন এক অন্ধকার রাতে। তাই বাবা-মা সময়ের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছেন নিশিথীনি। বস্তুত নিশিথীনি আঁধার রাতে যেন পূর্ণিমার আলো। সে যে পথে হাটে সে পথে ছড়িয়ে পড়ে আলোর বিচ্ছুরণ, চারপাশে ছড়ায় আলোক-উজ্জ্বল আভা। সে যেখানে বসে তার সৌন্দর্যের আলোর কাছে মাথা নত কৃত্রিম আলোর। চোখে নিশিথীনির স্বচ্ছ আলোকছটা। যেমন মরুভূমির বুকে মধ্যাহ্নের সূর্য আলোর বিচ্ছুরণ ঘটায়, নিশিথীনির চোখও মরুভূমির সূর্যের মতোই।

দেখা যায় তাকে, শুনা হয় না তার কথা। তাতে মামুনের নেই কোন দুঃখবোধ, কারণ দেখে ওর কৃঞ্চ গোলাপের দুটি ভ্রূ আর সুদীর্ঘপল্লববিশিষ্ট বড় বড় কালো দুটি চোখ। কবিগুরুর মতো বলতে হয়, ‘আমরা যে ভাবটা প্রকাশ করি, সেটা আমাদিগকে অনেকটা নিজের চেষ্টায় গড়িয়া লইতে হয়, কতকটা তর্জমা করার মতো; সকল সময়ে সঠিক হয় না, অক্ষমতার অভাবে অনেক সময় ভুলও হয়। কিন্তু কালো চোখকে কিছু তর্জমা করতে হয় না – মন আপনি তাহার উপর ছায়া ফেলে। আর মুখের ভাব বৈ আজন্মকাল, যাহার জন্য অন্য কোন ভাষা নাই, তাহার চোখ অসীম, উদার এবং অতলস্পর্শী গভীর – অনেকটা স্বচ্ছ আকাশের মতো’।

নিশিথীনির পরিচয়পর্বে আসি। নিশিথীনি মামুনদের অফিসে এসেছে ইন্টার্ণশিপ করতে। বসে মামুনদের ফ্লোরে এইচআর ডিপার্টমেন্টে। মামুনের মতো অনেক সহকর্মীর আগ্রহের নাম নিশিথীনি। সঙ্গত কারণে চায়ের রুমে ঘুরে ফিরে তার বিষয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলে। গল্পে গল্পে জানা গেল নিশিথীনির ডাক নাম নিশি। নিশি লাজুক-লাজুক, চুপচাপ, একা একা থাকতে-চলতে পছন্দ করে। ক্যাফেটোরিয়ায় প্রায়ই একা একা নিরিবিলি বসে খায়। ছিপ দিয়ে মাছ ধরার সময় যেমন শব্দহীন সঙ্গীই সর্বশ্রেষ্ঠ, নিশি অফিস চলাকালে মাছ শিকারীর মতো মগ্ন হয়ে কাজ করে, আশেপাশে কে কী করে তা তাকিয়েই দেখে না। পাশের সহকর্মীরাও হয়তো পড়ে ফেলেছে তাকে। তাই তারাও শব্দহীন সঙ্গীর মতো নিশিকে সঙ্গ দিচ্ছে।

ওয়াশ রুম, নামাজ রুম, চায়ের রুমে মামুনের সামনে দিয়েই যেতে হয়। নিশি যতবারই যায় মামুন নির্লজ্জের মতো হা করে তাকিয়ে থাকে। মনে বড় সাধ অপরূপ চোখে একটিবারের জন্য চোখ রাখার। মামুনের মতো আছে অনেকেই। কিন্তু তাদেরও সেই সাধ আর পূরণ হয় না। কারণ হেঁটে যাওয়ার সময় নিশি ডান-বামে কিছুই খেয়াল করে না; যেন পৃথিবীর সবকিছু তার নখদর্পণে, দেখার কিছুই নেই আর অবশিষ্ট।

মামুন কাজ করে আর ভাবে, আচ্ছা নিশিথীনির হাসি কেমন? নিশ্চয়ই পদ্ম ফুলের হাসি ওর মুখে। আচ্ছা, কথা বললে শোনায় কেমন? নিশ্চয়ই কণ্ঠে ওর পাতার বাঁশির সুর। নিশিথীনি কবিগুরুর ‘মাল্যদান’ গল্পের মতো, ‘শরীর ছিপছিপে মুখশ্রী সম্বন্ধে অধিক কিছু বলিবার নাই, কেবল মুখে একটা অসামান্যতা আছে যেন বনের হরিণ ভাব মনে আসে’। তার অধর দুটিকে সদ্যফোঁটা গোলাপ অথবা মিঠা পানির বাছা মাছের ঠোঁটের সাথে তুলনা চলে।

নিশির দুলে থাকা চুলের বেনিকে যত্নে গাঁথা মালা মনে হয়। ওর প্রতিটা পোশাক শালীন-সৌন্দর্যের প্রতীক মনে হয়। ওজু শেষে মাথায় ওড়না দিলে ঘোমটা দেয়া নতুন বউয়ের ছবি চোখে ভাসে। সেদিন সকালবেলা। চায়ের রুমে ঢুকতেই দেখে নিশি ফিল্টার হতে পানির বোতল ভরছে। মামুন আড়চোখে কচি লাউয়ের ডগার মতো হাতখানি পরখ করল অপলক দৃষ্টিতে, চোরাচোখে। কী যে মসৃণ সে হাতখানি। মামুন ভাবল, মর্ণিং শোজ দি ডে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো সারাটি দিন আর দেখা পেলনা ওর!

কিছুদিন পর। একদিন দুপুরবেলা। অফিসের কাছে কিছু কিনতে যাচ্ছে মামুন। ফুটপাতে হঠাৎ সামনে পড়ে গেল নিশিথীনি। নিশিথীনির মাথায় ছিল ওড়না। নিষ্পাপ-শ্রান্ত-প্রশান্ত মুখপানে চেয়ে হয়ে গল চোখাচোখি। মায়াভরা মুখখানি বুকটা শীতল করে দিয়ে গেল। মনে হলো এই চোখ কত চেনা, কত আপন। মামুন আনন্দে আত্মহারা। পূরণ হয়েছে মনের আশা। ভাবে নিশি যেভাবে তাকালো মনে হয়েছে আমাকে চিনতে পেরেছে। আর চিনাই স্বাভাবিক। কথা না হলেও কোন না কোনভাবে দেখতে তো পায়। আসলে মেয়েদের একটা স্বভাব হলো, ছেলেদের চিনেও না চেনার অভিনয় করা, দেখেও না দেখার ভান করা।

রাতে আর ঘুম আসে না মামুনের। শুধু চোখে ভাসছে নিশিথীনির ডাগর ডাগর চোখজোড়া। লেখালেখির অভ্যাস থাকায় মাঝ রাতে বসে পড়ল খাতা কলম নিয়ে।

মুখটি যেন পাহাড়ি ঝর্ণা
মাথায় ছিল তোমার গোলাপি ওড়না
মুখটি যেন ওই পাহাড়ি এক ঝর্ণা।
ছলাৎ ছলাৎ ঝর্ণা যেমন নামে পাহাড় বেয়ে
তোমায় দেখে মন তেমন উঠে গান গেয়ে।
রাজপথ ধরে হাটছিল রমনী কত শত
তোমার চোখে হলো আমার মাথা নত।
একি দেখলাম এ কোন আলোর জ্যোতি
সে আলো চলছে ছায়া হয়ে দিনরাতি।
কী এক ভালোলাগার দোলায় দুলে আমার মন
দুলতে দুলতে বেসামাল–খেয়ালি আমি সারাক্ষণ।

মেসে বন্ধুদের সঙ্গে নিশির সাথে দেখা হওয়া নিয়ে কত আলাপ-আলোচনায় রাত শেষ হলো। তারপরেও সকালে ফুরফুরে মেজাজে অফিসে রওনা হলো মামুন। লিফটের সামনে দেখে নিশিও দাঁড়িয়ে! বুকটা ধক করে উঠল। পাশে সহকর্মীরা হাই-হ্যালো করলেও মামুনের কানে কিছুই ঢুকছে না। অতি আশ্চর্য দৃষ্টিতে নিশির দিকে তাকিয়ে আছে; যেন জীবনে এমন কিছু দেখেনি। এমনিতে লিফটে সবাই স্বাভাবিকের চেয়ে মাথা একটু বেশিই নিচু করে থাকে। সহসাই হয়ে যায় শব্দহীন। সেখানে লাজুক  নিশিথীনির কোণায় জড়োসড়ো হয়ে থাকাটাই তো স্বাভাবিক। মামুন ভাবে, শনির দশা কাটিয়ে বৃহস্পতি এখন তার তুঙ্গে। মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি হচ্ছে। অনেকটা ক্রিকেট খেলার মতো। বোলার যখন উইকেট পাওয়া শুরু করে, তখন উইকেট পেতেই থাকে। তেমনি ব্যাটসম্যান চার-ছয় মারা শুরু করলে যেন চার-ছয়ের বন্যা বয়ে যায়। মামুন ভাবছে এখন সময় তার। সত্যি তাই। এদিনই লাঞ্চে দেখাদেখি হলো দুজনের। মামুন লাঞ্চ শেষ করে বের হচ্ছিল। আর নিশি ছিল লাইনে দাঁড়িয়ে। হাতের উপর হাত রেখে ভাবলেশহীনভাবে দাঁড়িয়ে ছিল ও। চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিল। এরপর থেকে মামুন নিশির খাওয়ার সময় পর্যবেক্ষণ পূর্বক ক্যাফেটোরিয়ায় আসা শুরু করে। তবে সব হিসেব সবদিন মেলে না। কোনদিন দেখা পায়, কোনদিন পায় না। তবে শেষ বিকেলে দেখা মিলল খানিকটা পরিবর্তিতরূপে।  চুলগুলো উঁচু করে খোঁপা করা। আসলে পরিবর্তন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।

আহা! এমন যদি হতো, যদি বলতে পারতাম, তোমাকে আজ লাগছে অন্যরকম। উল্টো প্রশ্ন করতো লাগছে কেমন? না চুলগুলো আজ তোমার…। আপনার ভালোলাগে? শুধু চুল নয় ভালোলাগে তোমার সবকিছু। লাজুক হাসত সে। সে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়ত সমস্ত কপালে।

এদিকে নিশিকে নিয়ে পুরোদমে নতুন উদ্যমে লেখালেখি শুরু হয়েছে মামুনের। চলছে ‘আমার নিশিথীনি’নামে গল্প। গল্প আর নিশিকে নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলে সহকর্মী কাম বন্ধু বাসু গুহের সাথে। আজ সকালে অফিসে ঢুকতেই ওয়েটিং রুমের সোফায় ফাইল হাতে বসা নিশি। মামুন ধীর পায়ে দেখতে দেখতে যেতে লাগল। নিশি ফাইল পাশে রেখে চুল বাঁধতে লাগল। মামুনের চোখ খুশিতে ভরে গেল। গুণগুণিয়ে গাইতে শুরু করলো, ‘তোমার চুল বাঁধা দেখতে দেখতে ভাঙল কাঁচের আয়না’। এদিন থেকে নিশি বসতে শুরু করে তৃতীয় ফ্লোরে।

ছাদে বাসু গুহের সাথে আলোচনা করে বইটা লেখা শেষ হলে কীভাবে হস্তান্তর করবে। বাসু পরামর্শ দেয় সবাই জানে তুমি লেখালেখি করো, তাই লেখক হিসেবে দিলে সাত খুন মাপ। মামুন ভরসা পায় বাসুর কথায়।

আজ মামুন লাঞ্চে গিয়ে দেখে নিশি একাকী খাচ্ছে। মামুন ভাবল এটাই বড় সুযোগ। ওর টেবিলেই বসতে হবে। বলতে হবে কথা। মামুনের হাটু কাঁপতে লাগল। গলা শুকিয়ে গেল। কাঁপতে কাঁপতেই ভাতের প্লেট নিয়ে দাঁড়াল নিশির সামনে।
মামুন– বসতে পারি? নিশি ঘাড় দুলিয়ে বলল হ্যাঁ, বসুন। মামুনের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, কথা শুরু হলে দ্রুতই স্বাভাবিক হয়ে যায়। নিশির সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলেছে। মামুন কবিগুরুর মতো বলতে চায়, ‘কে বলে জায়গা নেই, এই তো জায়গা পেয়েছি’।
মামুন– আপনি আমাকে চেনেন?
নিশি মাথা ঝাঁকিয়ে হালকা হেসে বলে, না। মামুন মনে মনে ভাবে কতবার চোখে চোখে পড়ল আর বলছে চিনি না। আসলে সুন্দরী মেয়েরা এমনই মিথ্যুক আর রহস্যময়ী।
মামুন: আমি আপনার নাম জানি।
নিশি: তাই? কীভাবে?
মামুন: সুন্দরী মেয়েদের নাম সবাই জেনে যায়। নিশি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। ঝরছে যেন হাসির ঝর্ণা। আর সেই ঝর্ণার লহরে ভাসছে মামুনের মন।
নিশি: আপনাকে কে বলেছে আমি সুন্দরী।
মামুন: আকাশে চাঁদ উঠলে কি লুকিয়ে রাখা যায়? নিশি অবাক হয়ে মামুনের কথা শুনছে। চাঁদ উঠার মতোই আপনার সৌন্দর্যের বিষয়টা চিরন্তন সত্য।
নিশি: বুঝেছি আপনার কথার সাথে পারব না। মামুন ভাবছে অল্প সময়ে যত বেশি বিষয় উপস্থাপন করা যায়।
মামুন: আমার আর একটা পরিচয় আছে।
নিশি: কী পরিচয়?
মামুন: আমি একজন স্বঘোষিত লেখক।
নিশি: স্বঘোষিত মানে?
মামুন: মানে বাজারে আমার কোন বই প্রকাশিত হয়নি। অর্থাৎ স্বীকৃতি নেই, এজন্য স্বঘোষিত।
নিশি: কী কী বিষয়ে লেখেন?
মামুন: গল্প, কবিতা, ছড়া, গান সবই লেখার চেষ্টা করি। হয় কি না জানি না।
নিশি: তো প্রকাশের উদ্যোগ নিচ্ছেন না কেন?
মামুন: ভাবছি সামনের বই মেলায় চেষ্টা করব।
নিশি: অবশ্যই চেষ্টা করবেন। কত অল্প সময়ের পরিচয়। অথচ পরামর্শ দিচ্ছে অতি আপনজনের মতো। বেশ ভালো লাগছে।
মামুনের কথাও চলছে, খাওয়া চলছে। আর নিশির খাওয়ার গতি কমে গেছে। মনে হচ্ছে অস্বস্তিবোধ করছে।
মামুন: আপনার খাওয়ার ব্যাঘাত ঘটছে আমি উঠি।
নিশি: না, না ঠিক আছে।
মামুন: কিছুদিনের মধ্যে একটা গল্পের পাণ্ডুলিপি লেখা শেষ হবে। সেটা বই আকারে প্রস্তুত করব। আপনাকে একটা কপি দিলে নিবেন?
নিশি: মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়।
মামুন: আমার কথায় কিছু মনে করলেন না তো?
নিশি: না, না, মনে করার কী আছে। মামুন ধন্যবাদ দিয়ে উঠে চলে যায়। নিশি মামুনের দিকে একটু পেছন ফিরে তাকায়।

ছুটির দিনে নিশি তার এক বান্ধবীর কাছে বলে, জানিস অফিসে এক স্বঘোষিত লেখক আচমকা খাবার টেবিলে হাজির। আমার নাম-ধাম সব জানে। বান্ধবীটি জানতে চায়, তারপর?
নিশি হাসে আর বলে, বলে যে আমি তাকে চিনি কি না? আমি চিনেও না উত্তর দেই। সে আমাকে ফলো করছে তা কয়েকদিন ধরেই বুঝতে পারছি।
বান্ধবী: তো লেখক তো শেষ।
নিশি: আমারও তো তাই মনে হয়।
বান্ধবী: তো কী করবি?
নিশি: কী আর করব খুশিতে নাচি চল বলেই দুজন অট্ট হাসিতে ফেটে পড়ে।

কথায় বলে, শুরু ভালো হলে অর্ধেক কাজ শেষ হয়ে যায়। নিশির সাথে কথার পর থেকে জড়তা কেটে গেছে। সাহস গেছে বেড়ে মামুনের। দেখা-সাক্ষাতে হাই হ্যালো হচ্ছে। আজ ক্যাফেটোরিয়ায় নিরিবিলি দুজন আলাপ জমিয়েছে।
মামুন: আচ্ছা আপনাদের গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর কাজলায়, ঢাকার শান্তিনগর।
নিশি: গ্রামের বাড়ি পর্যন্ত গেলেন কীভাবে?
মামুন: সেদিনই তো বলেছি, সুন্দরী মেয়েদের সব খবর জানতে হয় না, জেনে যায়।
নিশি: আর কী জানেন?
মামুন: জানার চেষ্টা করছি। আচ্ছা শান্তিনগর নাম হলো কেন?
নিশি: কী করে বলব?
মামুন: আমার মনে হয় ওই এলাকায় একসময় অশান্তি ছিল। শান্তি প্রতিষ্ঠার হওয়ার পর নাম হয়েছে শান্তিনগর।
নিশি: আপনি লেখক মানুষ। কত কী মনে হয় – তার ঠিকানা আছে?

আকাশের ওই রৌদ্র-খেলাকে অনেকেই শুধু খেলা বলে তুচ্ছ গণ্য করে। নিশিকে নিয়ে মামুনের ভাবনাকে অনেকেই সামান্য জ্ঞান করতে পারে। আসলে ওকে নিয়ে ভাবনার মধ্য দিয়ে মামুনের জীবনের সুখ-দুঃখের বীজ অঙ্কুরিত হতে চলেছে। প্রতিটি মানুষের দুইটি জগৎ থাকে। এক – বাস্তব জগৎ, দুই – কল্পনার জগৎ। প্রকৃতপক্ষে মামুনের কল্পনার পুরো জগৎ জুড়ে বাস করছে নিশিথীনি। আর তাই তো প্রায় নির্ঘুম খেটে ‘নিশিথীনি’বই আকারে পাণ্ডুলিপি তৈরি করল সে। গল্পের বিষয়বস্তু মামুনের দেখা-অদেখা, বাস্তব-কল্পনামিশ্রিত নিশির পুরো জীবনগাথা। জলছবির পোর্ট্রেটে মাথায় গাঁদা ফুলের ডালা, হলুদ মলাটের কভার ফটো নিশিথীনির মতোই। মামুন খামে ভরা বইটি নিয়ে নিশির সামনে হাজির। আশেপাশে তেমন কেউ নেই।
মামুন: বইটি আপনাকে নিয়ে লেখা। পড়ে মন্তব্য করবেন। তাকে নিয়ে লেখা শুনেও নিশি তেমন অবাক হলো না। আধো হেসে বইটি নিল। তার মানে ওর প্রেমে মামুন হাবুডুবু খাচ্ছে এটা ভালোভাবেই বুঝে গেছে নিশি। বস্তুত মেয়েদের ঈশ্বরপ্রদত্ত বিশেষ ক্ষমতা আছে ছেলেদের মন পড়ার।

বই হস্তান্তর করার পর থেকে ফোনটা হাত থেকে নামাচ্ছে না মামুন। একটু একটু পর পর মেসেজ, হোয়াটসআপ, মেসেঞ্জার চেক করছে। ভাবছে বইয়ে লিখে দেয়া ফোন নম্বরে ফোন দিবে নিশ্চয়ই। বলবে আমাকে নিয়ে দেখছি পিএইচডি করে ফেলেছেন। আমি বলব শুধুই আপনার জন্য। অথবা মেসেজে ভেসে উঠবে, অনেক চমৎকার আপনার লেখার ধরন। আবার ভাবে ওকে নিয়ে লেখার কারণে মন খারাপ করলো না তো। নিজেই উত্তর দেয়, কাউকে নিয়ে গল্প-কবিতা লিখলে খুশিই তো হওয়ার কথা। কিন্তু মাঝ রাতেও ভালো-মন্দ কোন খবরই আসল না। মেসের বন্ধুরা অফিসে গিয়ে সরাসরি মন্তব্য শোনার পরামর্শ দিল। এপাশ-ওপাশ করতে করতে মোবাইল ফোনটা বুকে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরে ঘুম ভাঙ্গলে চোখ বুলায় ফোনের স্ক্রিনে। কিন্তু এতে হতাশাই বাড়ে মামুনের।

ওদিকে নিশি একবার শেষ করে আবার পড়া শুরু করেছে। শুয়ে শুয়ে একটু একটু করে পড়ে আর লজ্জার হাসিতে বই দিয়ে মুখ ঢাকে। ভাবে একটা মানুষ অচেনা মানুষকে কল্পনা করে এমন সত্য তুলে ধরে কেমনে? তার মানে ও আমাকে এতো…। আবার মিটিমিটি হাসিতে বই দিয়ে মুখ লুকায়। নিশির মা বলেন, নিশি আলো নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়। নিশি আলো নিভিয়ে মোবাইলের আলোতে বইয়ের পাতা উল্টাতে থাকে। মোবাইল নম্বরটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। ভাবে, নিশ্চয়ই ও ফোনের অপেক্ষায় আছে। একটু মজা না নিয়ে ফোন দিব এত সোজা নয়। প্রেম করবে আর টেনশন করবে না তাই কি হয়?

নিশি ফুরফুরে মেজাজে আর মামুন অস্থির মনে অফিসে প্রবেশ করে। মামুন চেয়ারে বসে আবার উঠে। বস জানতে চায় কোন সমস্যা? মামুন বলে ঠিক আছে। মামুন একবার ভাবে ইন্টারকমে ফোন দিয়ে কথা বলবে। আবার ভাবে আমাকে নিয়ে কেউ বই লিখলে খুশিতে ডগমগ হয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতাম। থাক দেখি কী করে? ওদিকে অন্যদিনের চেয়ে নিশি বেশি হাসি-খুশি। সাজুগুজু করেছেও বেশি। লাঞ্চে নিশি তার সহকর্মীদের সাথে খেতে বসেছে। মামুন দেখলেও নিশি মামুনকে দেখতে পায় না। এক বুক কষ্ট নিয়ে খেয়ে চলে আসে। বন্ধু বাসুর সাথে শেয়ার করে বিষয়টা। বাসু ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেয়। দুপুর গড়িয়ে বিকেল। অফিস ছুটির সময় হলো। মামুন অধৈর্য হয়ে নিশির ইন্টারকমে ফোন দেয়। বলে একটু ছাদে আসতে পারবেন?
নিশি– হাতে যে কাজ।
মামুন: পাঁচ মিনিটের জন্যেও আসতে পারবেন না?
নিশি: ঠিক আছে সাড়ে পাঁচটার সময়। ফোন রেখে নিশি ঠোঁট চিপে হাসে। ভাবে বুঝো প্রেমে পড়ার মজা। ওদিকে মামুনের অস্থিরতা কাটছেই না।
ঠিক পাঁচটার সময় মামুন একটু আগে আর নিশি একটু পরে ছাদে আসে। নিশি ছাদের ফুল দেখিয়ে বলে, চিনেন এই ফুল?
মামুন: একটু গম্ভীর গলায়, না।
নিশি: লেখকদের ফুল-পাখি বেশি বেশি চিনতে হয়।
মামুন: আপনি চিনিয়ে দিবেন।
নিশি: কী?
মামুন: না, বলেন এটা কী ফুল।
নিশি: এটা কাঠগোলাপ ফুল। এই ফুলের বৈশিষ্ট্য হলো, কোনটা দুধের মতো ধবধবে সাদা, কোনটার সাদা পাপড়ির উপর হলুদ দাগ আবার কোনটা লালচে গোলাপি রঙের। আমার খুব পছন্দের ফুল এটা। মামুন ভাবে এটা-সেটা বলে সময় পার করছে। এতো খুব চালাক।
মামুন: আচ্ছা বইটা পড়েছিলেন?
নিশি: একটু পড়েছি। পুরো পড়ার সময় পাইনি।
মামুন: যেটুকু পড়েছেন কেমন লাগল?
নিশি ফুল গাছে হাত বুলাচ্ছে আর বলছে, ভালো।
মামুন: শুধুই ভালো?
নিশি: পুরো পড়লে পুরো মন্তব্য করতে পারব।
মামুন: আজ পড়বেন?
নিশি: দেখি।
মামুন: এত কষ্ট করে লিখলাম। আর আপনি গুরুত্বই দিচ্ছেন না।
নিশি: কে বলেছে গুরুত্ব দিচ্ছি না।
মামুন: আচরণেই বোঝা যাচ্ছে।
নিশি: আচ্ছা আজকে পড়ব, হলো তো?
মামুন: না হয়নি। আপনার ফোন নম্বর দেন। আমি রাত দশটার সময় ফোন দিব। মামুন বেসামাল হয়ে পড়েছে। নিশি ফোন নম্বর দিয়ে বলে এগারটায় ফোন দিয়েন।
মামুন: দশটা না কেন?
নিশি: বাবা-মা ঘুমায় দশটার পর।
মামুন: ঠিক আছে।
নিশি মামুনের অস্থিরতা দেখে মনে মনে হাসে। আর ভাবে পুরোই পাগল হয়ে গেছে। আর একটু পরীক্ষা নিলে পাবনা পাঠাতে হবে।

নিশি সবকিছু গোছগাছ করে বই নিয়ে পড়তে থাকে। কবিতাটি পড়ে বারবার ‘মুখটি তার পাহাড়ি ঝর্ণা’। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে আর হাসে। ওদিকে পায়চারি করতে করতে কাটায় কাটায় এগারটার সময় ফোন দেয় মামুন। নিশি রিসিভ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। মামুন হ্যালো হ্যালো বলতে থাকে। অপর প্রান্ত থেকে ধীর মিষ্টি গলায় বলে, ‘হ্যালো’। এই হ্যালো শব্দটা মামুনকে অবশ করে ফেলে। মামুন ভাবে কোন নারীর কণ্ঠ এত মধুর হয়? নিজেকে সামলে নিয়ে মামুন জানতে চায় বই পড়েছে কিনা?
নিশি: পড়েছি।
মামুন: মন্তব্য।
নিশি: আপনার পেটে এত কথা বই না পড়লে বুঝতে পারতাম না।
মামুন: আপনাকে দেখলেই আমার লেখা আপনাআপনি চলে আসে।
নিশি: তাই?
মামুন: কী করলে বুঝবেন আমি সত্য বলছি।
নিশি: কিছু করতে হবে না।
দুজনের ফোনালাপ জমে উঠে। রাত শেষ হয় কিন্তু কথা শেষ হয় না। এক পর্যায়ে মামুন নিশিকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে ফেলে। অনুমতি ছাড়াই তুমি বলে সম্বোধন করে। নিশি পুরোটাই উপভোগ করতে থাকে। নিশির উত্তর পাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। নিশি ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেয়।

পরেরদিন থেকে মামুন-নিশি লাঞ্চে একসাথে খায়। মামুন তার প্রস্তাবের বিষয়ে নিশির জবাব চায়। নিশির একটাই কথা ধৈর্য ধরেন। নিশির স্থায়ী নিয়োগ হয় এই কোম্পানীতে। ওদিকে মামুন-নিশির মেলামেশায় অনেকেই বিশেষ করে নিশির প্রতি যারা দুর্বল ছিল তারা কানাঘুষা করে। বাসু মামুনকে সাবধান হয়ে চলার উপদেশ দেয়। শুক্রবার নিশি মামুনের সাথে বাইরে বেড়াতে যেতে রাজি হয়।

মামুন ভোরবেলা থেকেই সাজতে শুরু করে। মামুন ভাবে কালো প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট সাথে টাই – উত্তম কুমারকে কী স্মার্ট লাগে। মামুনেরও উত্তম কুমার হওয়ার সাধ জাগে। কিন্তু টাই বাঁধতে গিয়ে ঘটল বিপত্তি। সেই কবে টাই পড়েছিল। ভুলে গিয়ে আর পরতে পারছে না। মেসের এক বড় ভাইয়ের সাহায্যেও কাজ হলো না। এদিকে সময় যায় চলে। টাই ফেলে দেয় দৌড়। নিশি নীল কাতান পড়েছে। নীল পরির মতো ঝিলমিল করছে। চোখ ফেরানোই দায়। ৩০০ ফিটে গিয়ে নানাপদের ভর্তা দিয়ে ভাত খায় দুজন। মামুন নিশির চোখের দিকে তাকিয়ে ভাত খায়।
নিশি– এমনভাবে তাকিয়ে থাকলে লোকে কী বলবে?
মামুন– তোমার আঁখিতে আমার নাম দেখতে পাই তাই তাকিয়ে আছি।
নিশি– কাব্যিকতা রাখেন।
মামুন– তুমি নিজেই একটা কবিতা। তোমাকে রাখি কেমনে? আচ্ছা মটুর মতো একটা আইডিয়া এসেছে মাথায়।
নিশি– কী আইডিয়া?
মামুন– তুমি আমাকে তুমি বলো আর কঠিন কিছু বলতে হবে না, তাতেই বুঝব তুমি আমাকে ভালোবাসো।
নিশি– পারব না।
মামুন আকস্মিক নিশির হাত ধরে। নিশি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মামুনের চোখের পানে।
নিশি– হাত ছাড়ো।
মামুন– ‘তুমি’ না বললে হাত ছাড়ব না।
নিশি– আচ্ছা বাবা, তুমি, তুমি, তুমি বলে হাত জোর করে ছাড়িয়ে দূরে সরে যায়। মামুন পেছন থেকে এলো চুলে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেয়। দুজন দুজনের দিকে হেসে হাত ধরাধরি করে হাঁটতে থাকে।

নিশির পড়ালেখা শেষ। চাকরিও করে ভালো। তার উপরে অপরূপা। বিয়ের বাজারে কদর তাই অনেক বেশি। বাবা-মাও এই সুযোগে বিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। সরকারি বড় কর্মকর্তা প্রস্তাবও পাঠিয়েছে। সবকিছু শুনে দুজনের মন ভীষণ খারাপ। নিশি তার ছোট মামাকে দিয়ে মামুনের বিষয়ে তার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলায়। কিন্তু নিশির বাবা-মায়ের সাফ কথা সরকারি বড় চাকুরে ছেলে ছাড়া বিয়ে দিবে না। অনেক আলাপ-আলোচনা করেও কোন উপায় বের করতে পারে না দুজন। নিশি পালিয়ে বিয়েতে রাজি। কিন্তু মামুন রাজি নয়। নিশি ওর বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আর মামুন তার বাবা-মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান। দাদা-দাদি-চাচা-চাচিসহ যৌথ সংসার। সবাই চায় মহাধুমধাম করে মামুনের বিয়ে দিতে। তাছাড়া নিশিকে নিয়ে পালালে ওর বাবা-মা মামলা করার ভয় দেখিয়েছে। শেষে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। এলাকায় ছিঃ ছিঃ পড়ে যাবে। মামুন কিছু ভাবতে পারে না। কেউ সঠিক উপদেশও দিতে পারছে না। অফিস ছুটি শেষে মামুন-নিশি গুলশান লেকপাড়ে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে।
নিশি– তুমি আমাকে ভুলে যাও।
মামুন– এই কথা বলতে পারলে?
নিশি– পালিয়ে বিয়ে করতে পারবে না। তো কী বলব?
মামুন– শোন আগামীকাল বাড়ি যাব ভাগ্নির বিয়েতে। বাড়িতে দুলা ভাইদের সাথে আলাপ করব। দেখি তারা কোন পরামর্শ দিতে পারে কিনা?
নিশি– আমি কিছু জানি না। বাবা-মা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। কিছু হয়ে গেলে আমার দোষ দিতে পারবে না। তাছাড়া দেশের করোনা পরিস্থিতি মনে হয় খারাপের দিকে যাচ্ছে। যেকোন সময় দেশে লকডাউন দিতে পারে। তখন তুমি আসবে কী করে?
মামুন– লকডাউন হওয়ার মতো পরিস্থিতি হতে দেরি আছে। আমি তো রবিবারেই চলে আসব।
নিশি– যা ভালো বুঝ করো। বিষণ্ণ মনে দুজন বিদায় নেয়।

মামুন ২৪ মার্চ বাড়িতে যায়। বাড়িতে এসেই ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে লকডাউনের খবর খবর পায়। দূরপাল্লার বাসসহ সমস্ত গণপরিবহন বন্ধ হয়ে যায়।
নিশি মামুনকে ফোন দেয়। এখন কী হবে? বাবা-মা ফুসফাস করে কীসব বলছে বুঝি না। তুমি মনে হয় আমাকে হারালে।
মামুন– তুমি চিন্তা করো না। দেখি আসার কোন ব্যবস্থা করতে পারি কি না?
নিশি– তুমি আসতে পারলেই বা কী করবে?
মামুন– দরকার হলে পালিয়েই বিয়ে করব।
নিশি– চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। তোমার অবস্থা দেখছি তাই। রাখ আম্মু ডাকছে।

এদিকে মামুনের বাবা-চাচারা এই অবস্থায় কোথাও যেতে দিবে না মামুনকে।
অন্যদিকে নিশির বাবা ভাবছে লকডাউন হয়ে গেলে বিয়ে দেয়া কঠিন হবে। তাই যা করার রবিবারের মধ্যেই করতে হবে।
পরেরদিন নিশি মামুনের হোয়াটসআপে মেসেজ দিল ‘আজ আমার বিয়ে। তুমি সুখে থেক’। মেসেজ দিয়েই ফোন সুইচ অফ করে দিল নিশি।

মেসেজ পেয়ে মামুন পাগলের মতো হয়ে গেল। বারবার ফোন দিয়েও আর যোগাযোগ করতে পারল না। নিশি ছাড়া আর কারও নম্বর নেই মামুনের কাছে। নিশির ফেসবুক ফ্রেন্ডদের সাথে যোগাযোগ করলেও তারা কিছু জানে না বলে জানায়। এছাড়া আতঙ্কজনক পরিবেশে কেউ কোন প্রকার সহযোগিতা করতে অপরাগতা প্রকাশ করে। বাড়ির অনেকেই বুঝতে পারে বিষয়টা। সমবয়সী বোনেরা সান্ত্বনা দেয় মামুনকে। মামুন এক সময় নীরব হয়ে যায়, শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
রাতে বিছানায় অঝোরে কাঁদে মামুন। ওদিকে কাঁদতে কাঁদতে বিয়ের পিড়িতে বসেছে নিশি। মামুন ভাবে, ‘যেদিন ওর চোখে চোখ পড়েছিল, সেদিন প্রেমের কুহনে, সুখের আবেশে, সৌন্দর্যের মরীচিকায় সমস্ত ভবিষ্যতজীবন প্রফুল্লময় হয়ে উঠেছিল। আজ কেবলই মনে হচ্ছে আশাহীন ধূধূ মরুভূমি; যেন দেয়াশলাইয়ের কাঠি, মিনিটখানেক জ্বলে একেবারে পুড়ে গেছি। বেঁচে থাকার বুঝি কোন সুখও নেই, মানেও নেই’।

‘এ বড়ো কৌতূহল, এ বড়ো রহস্য। এক টুকরা হীরক পাইলে তাহাকে নানাভাবে নানাদিকে ঘুরাইয়া, ফিরাইয়া দেখিতে ইচ্ছা করে, আর একটি ক্ষুদ্র মানুষের মন বড়ো অপূর্ব। ইহাকে কত রকম স্পর্শ করিয়া সোহাগ করিয়া, অন্তরাল হইতে, সম্মুখ হইতে, পার্শ্ব হইতে দেখিতে হয়। কখনো কানের দুলে দোল দিয়ে, কখনো বিদ্যুতের মতো সহসা সচকিতে, কখনও নক্ষত্রের মতো দীর্ঘকাল এক দৃষ্টি, নব নব সৌন্দর্যের সীমা আবিস্কার করিতে হয়’।
উপরের উদ্ধৃতি রবি ঠাকুরের ‘মধ্যবর্তিনী’ গল্পের। নতুন বৌ শৈলবালাকে পেয়ে এমনি বেসামাল অবস্থা হয়েছিল নিবারণবাবুর। নিশিথীনিকে যে পাবে তার অবস্থাও হবে নিবারণবাবুর ন্যায়। আগে নিশিথীনির ধরবে চিবুক, না ছোঁবে কপোল, নাকি স্পর্শ করবে অধর আগে, নাকি চেয়ে রবে তা হরিণী চক্ষুদ্বয়ের দিকে – দিশা করতে করতেই হয়ে পড়বে দিশাহীন।

নিশিকে হারানোর বেদনা, বাংলদেশসহ বিশ্বব্যাপী করোনায় বিপর্যস্ত গোটা মানবসভ্যতা, মৃত্যুর কাছে মানুষের অসহায় আত্মসমর্পণ – সবমিলিয় মনটা বিষিয়ে উঠেছে মামুনের। বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি ঘটছে। হাসপাতালে সেবা না পেয়ে মানুষ রাস্তাঘাটে মরে পড়ে থাকছে। এমন সংকটকালে মামুনের ঢাকায় অবস্থানরত কয়েকজন বন্ধু যোগাযোগ করে। তারা করোনাকালে স্বেচ্ছাসবী সংগঠন করতে চায়। অর্থের জোগান দিবে প্রবাসী কয়েকজন স্বজন। মামুন প্রস্তাবটি লুফে নেয়। ভাবে মানসিক এই অবস্থায় সেবামূলক কাজে ডুবে থাকা যাবে, কিছুটা হলেও ভুলা যাবে নিশিকে। দাদা-দাদি-মা রাজি না হলেও বাবা-চাচারা সমর্থন দেয়। মে মাসের মাঝামাঝি মামুন ট্রাকযোগে ঢাকা চলে আসে। উঠে নিজ মেসে। ঢাকায় নেমে করোনা ভয়ের চেয়ে নিশির স্মৃতি বেশি কাহিল করে ফেলে। ভাবে নিশি কেমন আছে, সুস্থ আছে তো? মনকে শক্ত করে বন্ধুদের সাথে মানবসেবায় নেমে পড়ে। ওরা গাড়ি করে করোনা রোগীদের হাসপাতালে পৌছানোর কাজ শুরু করলো। সাথে সানিটাইজার, মাস্ক, প্যারাসিটামলসহ প্রাথমিক চিকিৎসার ওষুধ বিনামূল্যে বিতরণ করতে লাগল। গাড়ির সামনে লেখা ‘বিপদের বন্ধু’। ১০ টি গাড়িতে সারা ঢাকায় এই সেবা অল্পদিনের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলে দিল। গণমাধ্যমেও ফলাও করে প্রচার হলো বিপদের বন্ধুর মানবিক কর্মকাণ্ডের। টিভিতে ছেলের ভালো কাজের খবার শুনে, ছবি দেখে আনন্দে কাঁদে মামুনের মা-দাদি।

বিপদে পড়া মানুষদের সাহায্য করতে পেরে মামুনের মন হালকা হতে লাগল। তবে মনটা খারাপও হয় অনেক সময়, যখন দেখে মানুষ শ্বাসকষ্টে ছটফট করছে, হাসপাতালের সামনে মরে আছে, কোন স্বজন এগিয়ে আসছে না। আন্জুমান মফিদুল লাশ নিয়ে দাফনের ব্যবস্থা করছে। অথচ এই মানুষটি ছিল পরিবারের কত আপন, হয়তো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। হায়রে খোদার লীলাখেলা – দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে মামুন!

এতসব খারাপের মধ্যেও মামুনের ভালো লাগছে ঢাকার গাছে গাছে সবুজের সমারোহ আর নির্মল বাতাস। লকডাউনে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু এখন দূষণমুক্ত। মামুন ভাবে ঢাকার বাইরে কর্মস্থান করতে পারলে ঢাকা সারাবছর এমনি থাকত। পরিবারের সবাই সাবধানে থাকার জন্য পরামর্শ দেয়। মামুন বলে তোমরা চিন্তা করো না, আমি ঠিক আছি।

ঈদুল ফিতরের পরের সপ্তাহের একদিন। রাতে মিরপুর থেকে ঢাকা মেডিকেলে এক রোগী নিয়ে গেছে মামুনেরা। ভর্তির ব্যবস্থাশেষে বের হয়ে চলে আসছে।  গেটের সামনে গেলে বামপাশে কাঁথা জড়ানো মানুষের মতো মনে হয়। তাছাড়া করোনা রোগী গেটে ফেলে যাওয়ার ঘটনা তো প্রতিনিয়তই ঘটছে। মামুন আস্তে আস্তে এগিয়ে যায়। মুখসহ সমস্ত শরীর কাঁথা দিয়ে ঢাকা। মামুন ভাবে মারা গেছে নাকি। পিপিই ভালোভাবে ঠিক করে নেয়। তারপর আস্তে করে মুখটা খুলে। মুখ দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠে। এই তোরা আয়। ঝুঁকির বিষয় ভুলে যায়। হন্তদন্ত হয়ে গ্লাভস খুলে হাত ধরে। শরীর এখনও গরম, মানে বেঁচে আছে আমার নিশি। বুক ভেঙে যাচ্ছে মামুনের। ডুকরে কাঁদতে থাকে। বন্ধুদের বলে আমার নিশি তোরা এম্বুলেন্সে উঠা। উঠেই এক সাংবাদিক বড় ভাইকে ফোন দিয়ে পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে নিশিকে ধরে রাখে মামুন। বন্ধুরা সাবধান করলেও কিছু শোনে না।
আইসিইউ তে ভর্তি করানো হয় নিশিকে। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বেশ কিছু টেস্ট করানো হয়। ডাক্তার নার্সরাই সব করে। মামুনকে দূরে অবস্থান করতে বলেন তারা। ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার চেম্বারে ডাকে মামুনকে। সম্পর্ক জানতে চায়। মামুন বলে আমার সহকর্মী। ডাক্তার জানান, অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে, আমরা অক্সিজেন দিচ্ছি। অতিরিক্ত কাশিতে অজ্ঞান হয়ে গেছে। আশা করি দ্রুতই জ্ঞান ফিরবে। পারলে প্লাজমার ব্যবস্থা করেন। মামুন বলে, নিশ্চয়ই পারবো। নিজেদের পরিচয় দেয় মামুন। ডাক্তার বলেন, তাহলে তো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
মামুন বন্ধুদের প্লাজমার ব্যবস্থা করতে বলে। বন্ধুরা বলে তুই কোন চিন্তা করিস না। টাকা-পয়সা আমাদের ফাণ্ড থেকে খরচ করব। এদিকে নিশি জ্ঞান ফিরে নার্সের কাছে জানতে সে কোথায়। নার্স বলে আপনার কলিগ এখানে নিয়ে এসেছে। নিশি ডান-বামে তাকায়। নাম জানতে চায়। নার্স বলে আপনার কথা বলা নিষেধ। মামুনকে খবর পাঠায় নার্স। মামুন দৌড়ে যায়। নিশির সামনে দাঁড়াতেই চোখ জলে ভিজে যায় মামুনের। আর নিশি কোন কথা না বলে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে মামুনের চোখের পানে। মিনিট খানেক পর নিশি জিজ্ঞেস করে, তুমি? নার্স বলে উনিই তো আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছেন। এবার নিশির কপোল গড়িয়ে জল গড়তে থাকে। মামুন কাছে যেতে চায়। নার্স বাধা দেয়। মামুন বলে, ডাক্তার বলেছেন, তুমি দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে। নার্স মামুনকে বাইরে যেতে বলে। প্রয়োজন হলে ডাকবে। নিশি ঘুমিয়ে পড়ে। আর মামুন রাস্তায় এসে ভাবে, নিশির এই অবস্থা হলো কী করে। তাহলে ওর স্বামী? ঠিক আছে সুস্থ হলে সব জানা যাবে।
হাসপাতালে থাকতে বারণ করা হলেও মামুন হাসপাতালের বারান্দায় বসে রাত কাটায়। সকালে ঘুম ভাঙলে নিশি মামুনের সাথে দেখা করতে চায়।
মামুন গিয়ে দেখে নিশিকে বেশ ফ্রেশ লাগছে। মামুন জানতে চায় এখন কেমন লাগছে। নিশি বলে ভালো। নিশি বলে বাবা-মাও করোনা আক্রান্ত। তুমি একটু খবর নিবে। ফোন মুখস্থ বলে দেয় নিশি। মামুন বলে, তোমার স্বামী? নিশি চুপ হয়ে যায়,  চোখের কোণায় কয়েক ফোঁটা পানি দেখা গেল। নার্স বলেন বেশি কথা বলা যাবে না। মামুন বাইরে গিয়ে নিশির বাবাকে ফোন দেয়। নিশির বাবা-মা শুনে কাঁদতে থাকে। আসতে চায় হাসপাতালে। মামুন বলে, আপনারা এখনো অসুস্থ এভাবে আসা ঠিক হবে না। তাছাড়া আমি আছি নিশির কোন প্রকার অসুবিধা হবে না। নিশির মা জানায় দুই দিন ধরে ফোনে ওদের পাচ্ছিলাম না। ওর শাশুড়িও ফোন ধরছিল না। মামুন নিশিকে ওর বাবা-মায়ের খবর জানাতে চায়। নার্স জানায় ঘুমিয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে প্লাজমা দেয়া হয়েছে নিশিকে। শরীরের অবস্থা অনেকটা ভালো। আইসিইউ থেকে কেবিনে হস্তান্তর করা হয়েছে নিশিকে।

রাতে ঘুম ভেঙে গেলে নিশি মামুনকে ডেকে পাঠায়। মামুন গিয়ে দেখে নিশি বেডে বসে আছে। মামুন কাছে যেতে চাইলে নিশি নিষেধ দেয়। মামুন নিশির বাবা-মায়ের খবর দিয়ে ওর স্বামীর কথা জানতে চায়। স্বামীর কথা উঠাতেই ভীষণ মন খারাপ হয় নিশির। মামুন বলে বলতে না চাইলে থাক। নিশি মামুনকে দূরে চেয়ারে বসতে বলে। তারপর বলে, একদিনের ব্যবধানে প্রথমে আমার পরেরদিন ওর করোনার উপসর্গ দেখা দেয়।  দুজনেরই হালকা কাশি ছিল। ওর নাকি এ্যাজমার পুরনো রোগ ছিল। তাই সবাই ওকে হাসপাতালে ভর্তি হতে বলে। কিন্তু বাসার বাইরে যাবে না। হাসপাতালের খবরাখবর শুনে আস্থা পায় না। ওদিকে আমার বাবা–মায়েরও করোনার উপসর্গ দেখা দেয়। ভীষণ মন খারাপ আমার। সকালে হঠাৎ ওর কাশি বেড়ে যায়। ধরাধরি করে হাসাপাতালে নিতেই… আর বলতে পারে না নিশি।। ডুকরে কেঁদে উঠে। মামুনেরও চোখ ভিজে যায়। মামুন জানতে চায় মেডিকেলের গেটে এলে কী করে? নিশি জানায় শাশুড়ি-ননদ আমাকে অপয়া, ডাইনি বলে গালিগালাজ করতে থাকে। সন্ধ্যায় অসুস্থ হয়ে পড়লে একটি ভ্যানে করে বাড়ির দারোয়ান দিয়ে আমাকে হাসপাতালে পাঠানাো হয়। কিছুদূর আসার পর আমি বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর কিছু জানি না।

মামুন বাকিটা বলে, জানায় ঢাকায় তাদের কার্যক্রমের কথা। নার্স এসে বলে এখন বাইরে যান ডাক্তার দেখতে আসবে। মামুন নিশির জন্য হালকা কিছু কাপড়-চোপড় কিনে। তারপর মেসে গিয়ে কবুতর, কচি মুরগী নিজ হাতে রান্না করে নিয়ে যায়। নিজ হাতে আদা, এলাচ, দারুচিনি দিয়ে দিনে চার-পাঁচবার চা বানিয়ে খাওয়ায় নিশিকে। গরম পানির ভাপ, গড়গড়া করায়। নিশি বলে, আমার জন্য এত কষ্ট করছো কেন? মামুন বলে, ভালোবাসি তাই।
নিশি– ভালোবেসে কী পেলে?
মামুন– সবসময় কি চাওয়া-পাওয়ার হিসবে মেলে? তাছাড়া তোমার কাছে থেকে তোমার সেবা করতে পারছি এটাও কি কম পাওয়া? আচ্ছা বলতো তুমি সুস্থ হয়ে কোথায় উঠবে?
নিশি– এমন প্রশ্ন করতে পারলে? আমাকে তারা যদি ছেলের বউ মানতো তাহলে…।
মামুন– স্যরি। নিশি মন খারাপ করে বসে থাকে। মামুন বলে, বললাম তো স্যরি ভুল হয়েছে। শোন কাল তোমার প্রথম টেস্ট করানো হবে। ইনশাল্লাহ নেগেটিভ আসবে।
নিশি– আর পজিটিভ আসলে?
মামুন– এমন কথা বলতে নেই।
উদ্বিগ্ন মামুন পরেরদিন সন্ধ্যায় নিজেই গিয়ে রিপোর্ট উঠায়। কোভিড-১৯ নেগেটিভ দেখে মামুনের মুখে চওড়া হাসি। কিন্তু অন্য একটি রিপোর্ট দেখে মুহূর্তের মধ্যে সে হাসি মিলিয়ে যায়। মুখজুড়ে রাজ্যের কালো মেঘে ঢেকে যায়। খানিক সময় রাস্তায় ঘুরে স্বাভাবিক হওয়ার ভান করে নিশির কাছে আসে। হাসিমুখে বলে দেখ দেখ বলেছিলাম রিপোর্ট নেগেটিভ আসবে।
নিশি– তাই?
মামুন– এই যে দেখ রিপোর্ট দেখিয়ে বলে। একটু পরেই মামুন মুখ ভার করে বসে থাকে।
নিশি– তোমার মন খারাপ কেন?
মামুন– কই নাতো।
নিশি– তোমাকে আমি চিনি না? বাড়িতে কিছু হয়েছে?
মামুন– আরে না।
নিশি– তাহলে মন খারাপ কেন?
মামুন উঠে চলে যায়। ডাক্তারের কাছে পরামর্শ করে কীভাবে রিপোর্টের কথা বলা যায়। ডাক্তার জানতে চায় এই অবস্থাতেও কি আপনি নিশিকে বিয়ে করতে চান?
মামুন– হারিয়েও ফিরে পেয়েছি আর কোন অবস্থাতেই হারাতে চাই না।
ডাক্তার– তাহলে তো কারো কোন সমস্যা নেই। আমি নিশিকে খুলে বলব।
এদিকে নিশি ভাবছে মামুনের কেন মন খারাপ? ডাক্তার এসে নিশির কুশলাদি জানতে চায়। বলেন আপনার একটা খুশির খবর আছে?
নিশি বলে কীসের খুশির খবর? ডাক্তার বলে আপনি মা হতে চলেছেন। নিশির বুক ধক করে উঠে, চমকে যায়। ডাক্তার প্রেসার মাপছিলেন। যন্ত্রটি ছিটকে পড়ে যায়। ডাক্তার বলেন, সত্যি এই যে দেখেন আপনি ছয় সপ্তাহের প্রেগনেন্ট। মিষ্টি খাওয়ান। নিশি পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। ডাক্তার চলে যায়। নিশি তলপেট নেড়েচেড়ে দেখে। সবশেষ পিড়িওয়ড কবে হয়েছে মনে করার চেষ্টা করে, পারে না। তবে দেড় মাস আগে তো হবেই – এটুকু ধারণা করতে পারে। ইতিমধ্যে মামুন মাথা একটু নিচু করে কেবিনে প্রবেশ করে।
নিশি– আমি মা হবো। এটা তো আমার খুশির খবর। আমার খুশিই তো তোমার খুশি। তবে মন খারাপ কেন?
মামুন– শুকনো হাসিতে বলে কই আমার মন খারাপ? তাছাড়া তোমার বাচ্চা তো আমারই বাচ্চা। শোন আমি তোমাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাব।
নিশি– মানে?
মামুন– মানে বাচ্চার হওয়ার পর শরীয়ত মোতাবেক আমি তোমাকে বিয়ে করব।
নিশি– করুণা করতে চাও?
মামুন– করুণা নয়, আমি কোন অবস্থাতেই তোমাকে আর হারাতে দেব না।
নিশি– তা আর হয় না। আমি বাবা-মায়ের কাছে চলে যাব। আমার বাচ্চা নিয়ে বাকী জীবন কাটাব।
মামুন– পাগলামি করো না। তোমার জীবন মাত্র শুরু। জীবনে কিছুই দেখা হয়নি।
নিশি– সব দেখা শেষ। পঁচিশ বছর বয়সে স্বামী হারা, সংসার হারা হলাম। দেখার আর কী বাকি থাকল?
মামুন ভাবে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আস্তে আস্তে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। শোন আমি একটু মেসে যাচ্ছি। তুমি রেস্ট নাও। নিশি মাথায় চাদর জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। মামুন টেংরা, শিং মাছ ঝোল করে নিয়ে এসেছে। নিশি বলে আমি খাব না। মামুন বলে তুমি আর একলা না পেট দেখিয়ে বলে ওর জন্য হলেও খেতে হবে।
নিশি– আচ্ছা তুমি এত ভালো কেন?
মামুন– আমি ভালো হলে কি আর তোমার এত কষ্ট হয়?
নিশি– এখন কি পুষিয়ে দিতে চাও?
মামুন– যদি ভাবো তাই।

দুদিন পর আবার টেস্ট করানো হয়। এবারও রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। মামুন চুপি চুপি কেবিন ঢুকে। পেছন থেকে চোখ ধরে। নিশি বলে ছাড়ো। আমার শরীরে কিন্তু করোনা ভাইরাস।
– ভাইরাস জেনেই ধরেছি।
– রোগ নিয়ে পাগলামি করতে নেই।  
– আজ তো পাগল হওয়ারই দিন।
– আরে বাবা লাগছে তো।
মামুন বলে, ছাড়তে পারি। যদি চোখ বন্ধ করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকো।
– ঠিক আছে তবু চোখ ছাড়ো।
নিশি চোখ বন্ধ করে মামুনের সামনে দাঁড়ায়। মামুন বলে, আস্তে আস্তে চোখ খোল। নিশি চোখ খোলে। মামুন হাতে তালি বাজিয়ে বলে রিপোর্ট নেগেটিভ। তার মানে এখন থেকে তুমি করোনামুক্ত। এই উপলক্ষে তোমার জন্য এক গুচ্ছ কাঠগোলাপ উপহার। নিশি ভীষণ খুশি করোনামুক্ত হয়ে সাথে প্রিয় মানুষটির কাছে প্রিয় উপহার পেয়ে। বলে এই ফুল কোথায় পেল? মামুন নিশির দুহাত ধরে ধীরে ধীরে কাছে টানে আর বলে খুশি তো? নিশি হাসে কিন্তু চোখ তুলতে পারে না। মামুন জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয় নিশিকে। চিবুক ধরে মুখ উঁচুতে তুলে। মামুন বলে, চোখ খোল। বলেছিলাম না তোমার চোখে আমার নাম লেখা সেটাই আজ প্রমাণিত হলো। দুজন দুজনের চোখে চোখ রাখে। চোখ রাখতে রাখতে চুমু দেয়। মামুন নিশির অধর, চিবুক, চক্ষু, কপোল, ললাট, নাসিকা, কর্ণ, কেশ, ঘাড়, গ্রীবায় উপর্যুপরি চুমু দিতে থাকে। মুহূর্তেই চুমুতে চুমুতে দুজন ভেসে যায় চুমুর মহাসাগরে।

এসময় মামুনের ফোন থেকে সুর ভেসে উঠে, ‘হৃদয়ের একূল–ওকূল দুকূল ভেসে যায়, হায় সজনি’।