ওয়ান চিনা পলিসির আসল রহস্য – সদানন্দ সিংহ

ওয়ান চিনা পলিসির আসল রহস্য

সদানন্দ সিংহ

ওয়ান চিনা পলিসি বা এক চিন নীতি ব্যাপারটি মূলত তাইওয়ানকে ঘিরেই রচিত হয়েছে। ১৯৪৯ সালে চিন কমিউনিস্ট বিপ্লব এবং গৃহযুদ্ধের শেষে পরাজিত জাতীয়তাবাদী কুওমিন্টাংরা পিছু হটে তাইওয়ান দ্বীপে চলে আসে এবং নিজেদেরকে চিন প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করে যখন বিজয়ী কমিউনিস্টরা গণপ্রজাতন্ত্রী চীন হিসাবে মূল ভূখণ্ডে শাসন করা শুরু করে। গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের দাবী তাইওয়ান চিনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আর এখান থেকেই এসেছে এক চিন নীতির কথা। তাই শক্তি প্রদর্শন করে চিন প্রতিটি দেশের কাছে গিয়ে আঙুল উঁচিয়ে বলেছে, তোমাকে এক চিন নীতি মানতে হবে। বলা বাহুল্য, বেশির ভাগ দেশই এক চিন নীতির কথা মেনে নিয়েছে। চিনের বিরোধিতার কারণে তাইওয়ান রাষ্ট্রসংঘে এখনো যোগ দিতে পারেনি।

কিন্তু এক চিন নীতির মূল কারণ কি সত্যিই তাইওয়ান? নাকি আরো অনেক কিছু? উত্তরের জন্য একটু বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে চিন দেশের আয়তন বর্তমান চিনের চেয়ে ৪৩% ছোট ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেই চিনের আগ্রাসন নীতির ফলে চিন ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশের সীমানা দখল করে নিজের দেশের আয়তন বাড়াতে থাকে। প্রথমে দক্ষিণ মঙ্গোলিয়ার (Inner Mongolia) এক বিরাট অংশ দখল করে নিজেদের আয়তন বাড়িয়ে নেয়। দ্বিতীয় ভাগে চিন ১৯৪৯ সালে পূর্ব তুর্কিস্তানকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয় এবং এই স্থানের নতুন নামকরণ করে Xinjiang প্রদেশ বলে। তৃতীয় ভাগে চিন ১৯৫০ সালে তিব্বতকে কব্জায় নিয়ে নেয় এবং নতুন নামকরণ করে Xizang প্রদেশ। সবচেয়ে বেশি দমনপীড়ন চালানো হয় তিব্বতে। প্রচুর তিব্বতী মারাও যায় এইসময়। তিব্বতী গুরু দালাই লামা এবং তার অনুগামীদের এক অংশ ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আর ১৯৬২ সালের যুদ্ধে চিন ভারতের এক বিরাট এলাকা আকসাই চিন নিজেদের কব্জায় নিয়ে নেয়।  

দক্ষিণ মঙ্গোলিয়া, পূর্ব তুর্কিস্তান এবং তিব্বত-কে চিন এখনো স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ হিসেবে রেখেছে। কিন্তু স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল করে রাখলেও এখানকার জনসাধারণের ক্ষোভ দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। দক্ষিণ মঙ্গোলিয়া বা ইনার মঙ্গোলিয়ার মঙ্গোলিয়ান ভাষীরা স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে চিন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। ঠিক সেরকম অবস্থা পূর্ব তুর্কিস্তান বা Xinjiang প্রদেশে। এখানকার লোকের ৪৫% লোক উইঘর মুসলমান, ৪০% লোক চিনভাষী আর ১৫% লোক অন্য ভাষাভাষী। এই অঞ্চলের পুরানো মসজিদ ভেঙে চৈনিক কায়দায় নতুন মসজিদ করা হয়েছে। নতুন করে চিনা ভাষায় কোরাণ লেখা হয়েছে। দাড়ি রাখা নিষেধ করা হয়েছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে শোধনাগারে বন্দি করা হচ্ছে। যার ফলে প্রচুর উইঘর মুসলমান দেশ স্বাধীন করার জন্যে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা মুসলিম দেশগুলি এর বিরুদ্ধে কোনো আওয়াজই করছে না, যদিও কাশ্মীর প্রসঙ্গে একসাথে এনারা ভারতের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তিব্বত বা Xizang প্রদেশের অবস্থাও ভাল নয়। ওখানকার ৭৮% লোক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এখানে চিন নিজেদের ইচ্ছেমত নতুন দালাই লামার নাম ঘোষণা করে দিয়েছে, যদিও পৃথিবীর দিকে দিকে তিব্বতীরা এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন।

চিনের মূল ভূখণ্ডেও শোনা গেছে যে চিনের মান্দারিন ভাষী নয় এমন লোকেরা মাঞ্চুরিয়া, গুয়াংশি এবং ক্যান্টনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। ম্যাকাও এবং হংকংয়ের বেশির ভাগ লোক ক্যান্টনিজ ভাষী। চিনের কাছে ব্রিটিশদের দ্বারা হংকং হস্তান্তরের চুক্তি অনুযায়ী এবং পুর্তগিজদের দ্বারা ম্যাকাও হস্তান্তরের চুক্তি অনুযায়ী এই দুই জায়গার অধিবাসীদের পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত স্বাধীনভাবে থাকার অধিকার পাবার কথা। কিন্তু পরবর্তীকালে চিন এই সুবিধাগুলি বিলুপ্ত করার চেষ্টা করতে থাকে।

এসবের বাইরেও চিন ২৩টি দেশের জল-স্থল সীমানার ওপর নিজের এলাকা বলে দাবী করেছে যদিও চিনের সাথে সীমানা রয়েছে ১৪টি দেশের সঙ্গে। ভারতের অরুণাঞ্চল প্রদেশের ওপর চিনের দাবীর কথা পৃথিবীর কারুরই অজানা নয়।

ইদানীং আমেরিকার কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের পর চিন যেভাবে পাগলের মত যুদ্ধং দেহী মনোভাব নিয়ে সামরিক মহড়ার পর মহড়া শুরু করে যাচ্ছে তাতে চিন যে-কোনো মুহূর্তে তাইওয়ানের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে অবাক হবার কিছু নেই। চিন এখন ছলে বলে কৌশলে বা যুদ্ধে নেমে তাইওয়ান দখল করে এক চিন নীতি-র বিতর্কটা শেষ করতে চাইবে। কারণ চিন জানে পৃথিবীর সমস্ত দেশগুলি একে একে যদি এক চিন নীতি-র বিরুদ্ধে যেতে শুরু করে তাহলে তাইওয়ান তো হাতছাড়া হবেই, আস্তে আস্তে হয়তো সোভিয়েট ইউনিয়ন ভেঙে যাবার মতো অবস্থা হয়ে হংকং, ম্যাকাও, দক্ষিণ মঙ্গোলিয়া, পূর্ব তুর্কিস্তান, তিব্বত সবই হারাতে পারে। এটাই ওয়ান চিনা পলিসির আসল রহস্য। তাই চিন আজ ভীত এবং আহত বাঘের মত, কেবল যুদ্ধের ছক কষে চলেছে। এর ফলে হয়তো তৃতীয় মহাযুদ্ধের সূচনা হয়ে মানবজাতি গুরুতর দুর্দশায় পড়ে যেতে পারে।