জীবজন্তু প্রাণীদের নিয়ে পৃথিবীর আটটি সেরা গল্প – সদানন্দ সিংহ

জীবজন্তু প্রাণীদের নিয়ে পৃথিবীর আটটি সেরা গল্প

সদানন্দ সিংহ

জীবজন্তু ও প্রাণীদের নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় প্রচুর পৌরাণিক কাহিনি বর্তমান। পৌরাণিক কাহিনি ছাড়াও সাহিত্যে জীবজন্তু ও প্রাণীদের নিয়ে বিভিন্ন ভাষায় অনেক গল্প লেখা হয়েছে। এগুলির মধ্যে প্রাণীদের নিয়ে সেরা এবং সর্বাধিক পরিচিত ছোট গল্পগুলি কী কী হতে পারে তা নিয়ে হয়তো কিছু মতভেদ থাকতে পারে। অনেক ক্ল্যাসিক গল্পেই কিছু প্রজাতিকে বিশিষ্ট ভূমিকায় দেখা যায়। নিচে আমাদের পরিচিত বিড়াল-কুকুর, অ্যাক্সোলটল থেকে নেকড়ে সব ধরণের প্রাণী নিয়ে আটটি সবচেয়ে আইকনিক এবং বিখ্যাত গল্প নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।

১) এডগার অ্যালান পো, ‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাট’

পোয়ের সবচেয়ে অস্থির গল্পগুলির মধ্যে অন্যতম এই গল্পটি। গল্পটি পড়লে কোনো কোনো পাঠক নিজেই হয়তো এক অস্থিরতাবোধে আক্রান্ত হতে পারেন। আর কারুর কাছে আবার অনেকগুলি “কেন?”-র মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে।
‘দ্য ব্ল্যাক ক্যাট’ আসলে দুটি কালো বিড়ালের কাহিনি। দ্বিতীয়টি হয়তো প্রথমটির একটি সিমবলিক পুনর্জন্ম। দুটো বিড়ালের কাহিনি আবর্তিত হয়েছে এক মদ্যপ লোক(পরবর্তীকালে খুনি)-কে কেন্দ্র করে। প্লুটো নামের পোষ্য কালো বিড়ালটির সঙ্গে লোকটির খুব ভালো সম্পর্ক ছিল প্রথমদিকে। বেড়ালটি লোকটির খুব ন্যাওটা ছিল। কিন্তু একসময় মাতাল হয়ে লোকটি সবার সঙ্গে খারাপ আচরণ করতে শুরু করল। যদিও লোকটি বেড়ালটিকে কোনো আঘাত না করলেও, বেড়ালটি লোকটিকে একটু এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। এক রাতে লোকটি প্লুটো তাকে এড়িয়ে চলছে ভেবে তাকে ধরল। কিন্ত প্লুটো তাকে কামড়ে দেয়। রাগে লোকটি বেড়ালটির একটা চোখ কেটে ফেলে। প্লুটো এক চোখ নিয়ে বেঁচে গেলেও সে সবসময় লোকটিকে এড়িয়ে চলতে থাকে। তা দেখে লোকটি অনুতপ্ত হওয়ার পরিবর্তে বেড়ালটির প্রতি আরো বিরক্তিবোধ হতে লাগল। একদিন সে বেড়ালটিকে ধরে ঠাণ্ডা মাথায় একটা গাছে ঝুলিয়ে রাখে। সেদিন রাতে লোকটির ঘর পুড়ে যায়।  তাতে লোকটির স্ত্রী ও চাকর বেঁচে গেলেও তার ঘরবাড়ি এবং সমস্ত সম্পত্তি আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। ঝুলিয়ে রাখা বেড়ালটিকেও সে আর দেখতে পায় না। পোড়া ধ্বংসস্তূপের মাঝে একমাত্র দাঁড়িয়ে থাকা দেয়ালে সে বেড়ালের  এক ছবি দেখতে পায়। তারপর মাসের পর মাস পেরিয়ে যায়। একদিন লোকটি  প্লুটোর মত এক কালো বিড়ালকে দেখতে পায়। শুধু এই বিড়ালটার বুকে এক সাদা প্যাঁচ ছিল। বেড়ালটা তাকে অনুসরণ করতে করতে বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতে এলে সে দেখে প্লুটোর মতোই এই বেড়ালটিরও এক চোখ নেই। এরপর এই বেড়ালটিকে সে যত ঘৃণা করতে লাগলো তত বেড়ালটা যেন তার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকলো। বেড়ালটার বুকের সাদা প্যাঁচটা যেন ফাঁসের দড়ির মতো রূপান্তরিত হতে থাকল প্লুটোর প্রতি তার অপরাধের এক স্মারক হয়ে। অবশেষে লোকটি উন্মাদ হয়ে কুড়াল নিয়ে বেড়ালটিকে হত্যা করতে গেলে লোকটার স্ত্রী তাকে বাধা দেয়। এতে সে আরো ক্রুদ্ধ হয়ে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করে বসে। স্ত্রীর লাশটিকে সে ঘরের ভেতর বেসমেন্টের ওয়ালের ভেতর লুকিয়ে রাখে। বেড়ালটিকে সে আর খুঁজে পায় না। এরপর তিন রাত বেড়ালের উপদ্রপহীন  পরিবেশে সে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। চতুর্থ দিন পুলিশ এসে স্ত্রীর অন্তর্ধান নিয়ে খোঁজ করতে থাকে। এইসময়  লোকটি বেসমেন্টের ওয়ালে ঠকঠক করে আওয়াজ দিতেই  আটকে পড়া বেড়ালটার ডাক দেয়াল ভেদ করে চলে আসে এবং শেষে স্ত্রীর দেহের খোঁজ মেলে।

২) মার্ক টোয়েন, ‘এ ডগস টেল’।

এই গল্পটি একটি অনুগত পোষা কুকুরের (যার নাম Aileen Mavourneen) দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে। এমনকি গল্পের প্রথম বাক্য শুরু হয়েছিল, “আমার বাবা ছিলেন একজন সেন্ট বার্নার্ড, আমার মা ছিলেন একজন কোলি, কিন্তু আমি একজন প্রেসবিটেরিয়ান। এই যে আমার মা আমাকে বলেছেন, আমি নিজে এই সুন্দর পার্থক্য জানি না. আমার কাছে এগুলি কেবল সূক্ষ্ম বড় শব্দ যার অর্থ কিছুই নয়। আমার মায়ের এমন প্রতি অনুরাগ ছিল; তিনি সেগুলি বলতে পছন্দ করেছিলেন, এবং অন্যান্য কুকুরগুলিকে অবাক এবং ঈর্ষান্বিত দেখায়, ভাবছিল যে সে কীভাবে এত শিক্ষা পেয়েছে …।” কুকুরছানাটিকে একজন নতুন মালিকের কাছে বিক্রি করা হয়েছে এবং তার মাকে রেখে যাওয়ার জন্য দুঃখিত, কিন্তু সে যে পরিবারটির সাথে বসবাস করতে যায় তার প্রতি সদয়। পরবর্তীকালে আইলিনেরও নিজের কুকুরছানা আসে। একদিন বাড়ির নার্সারিতে আগুন লেগে যায় এবং কুকুরটি তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পরিবারের শিশুটিকে নিরাপদে স্থানে টেনে নিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়ায়, তার উদ্দেশ্য ভুল বোঝাবুঝি হয় এবং নির্মমভাবে প্রহার করা হয়। ফলে তার একটি পায়ে ভাল চোট যায়। তবে শীঘ্রই, পরিস্থিতি সম্পর্কে সত্য ঘটনা জেনে বাড়ির মালিকরা তার  প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। পরে বাড়ির মালিক এবং তার বন্ধুরা আইলিনের ছানাকে পরীক্ষা করার জন্য ল্যাবোরেটারিতে নিয়ে যায়। তার কুকুরছানা জৈবিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মারা যায়। আইলিন দেখে তার ছানাটিকে মাটির নিচে দাফন করা হয়েছে। কেবল একজন ভৃত্যই বিড়ম্বনা বুঝতে পেরে বলেছিল, “বেচেরা হতভাগ্য কুকুর, তুমি মালিকের সন্তানকে বাঁচিয়েছ!”
এই গল্পে পশুদের প্রতি অমানবিক ও অবমাননাকর আচরণের চিত্র তুলে ধরার পাশাপাশি মুদ্রার অপর পাশে জীবন পর্যবেক্ষণ ও অনুভব আমাদেরকে পরিচালিত করতে পারে যা মানবতাকে প্রতিফলিত করে সমাজে মানুষ এবং প্রাণী উভয়ের ভূমিকা এবং সম্পর্ক নিয়ে এক পুনর্বিবেচনা করার উৎসাহ দেয়।

৩) রুডইয়ার্ড কিপলিং, ‘দ্য ক্যাট দ্যাট ওয়াকড বাই হিমসেলফ’।

রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর ‘দ্য জাঙ্গল বুক’ সবার প্রিয়। তবে ‘দ্য ক্যাট দ্যাট ওয়াকড বাই হিমসেলফগল্পটি হয়তো অনেকেই পড়েননি। প্রস্তরযুগের পটভূমিতে মানুষ, বিড়াল এবং কুকুরদের নিয়ে দীর্ঘ গল্প, কিভাবে প্রাণীরা মানুষের পোষ্য হয়েছিল।  কিপলিং-এর জাস্ট সো স্টোরিস (1902) এর মধ্যে একটি এবং মূল গল্পের এই ক্লাসিক সংকলনের সবচেয়ে দীর্ঘতম গল্প, ‘দ্য ক্যাট দ্যাট ওয়াকড বাই হিমসেল্ফ’-এর শিরোনাম থেকে বোঝা যায়, বিড়ালের স্বাধীন চেতনার উপর ভিত্তি করেই গল্পের নির্মাণ। শিশুদের কাছে এই গল্পের জনপ্রিয়তা এখনো আগের মতোই।

৪) সাকি, ‘টোবারমরি’।

কিছু ছোট গল্প লেখক শিশু এবং প্রাণী সম্পর্কে এত ভাল লিখেছেন, তবে হেক্টর হিউ মুনরো (1870-1914), যিনি সাকি নামে বেশি পরিচিত, উভয় বিষয়েই লিখতে পারেন। গল্পের মূল ঘটনা এক বিড়ালকে কেন্দ্র করে। কর্নেলিয়াস অ্যাপিন নামে একজন ব্যক্তি একটি বিড়াল, টোবারমরিকে কথা বলতে শেখাতে পেরেছেন। মিসেস ব্লেমলির হাউস পার্টিতে অ্যাপিন প্রকাশ করে যে তিনি টোবারমোরিকে বাকশক্তি শেখাতে পেরেছেন। প্রথমে পার্টির অতিথিরা স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাস করতে পারেনি। টোবারমরিকে সামনে নিয়ে আসা হলে সবাই দেখে ব্যাপারটা সত্যিই। কিন্তু সেটা অন্যদিকে মোড় নেয় যখন বিড়ালটিকে নানা প্রশ্ন করা হয় এবং উত্তরে বিড়ালটি যা তার কানে শুনেছে এবং দেখেছে তা পার্টিতে ‘সম্মানিত’ লোকেদের বলতে শুরু করে যে ব্লেমলেসকে মাভিস সম্পর্কে আলোচনা শুনেছেন এবং স্যার উইলফ্রিড মাভিসকে ‘মস্তিষ্কহীন মহিলা’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন ইত্যাদি ইত্যাদি। টোবারমরি তাদের জীবন সম্পর্কে সব জানে এবং তাদের সমস্ত অন্ধকার রহস্য উন্মোচন করবে এই ভয়ে অতিথিরা নার্ভাস হতে শুরু করে। সবাই চলে যাওয়ার পরে ব্লেমলেস টোবারমরি সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে তাকে এখন জীবিত রাখা যাবে না যেহেতু সে প্রত্যেকের গোপনীয়তা প্রকাশ করে দেবে এবং  তারা খাবারের ভেতর বিষ দিয়ে হত্যা করার সংকল্প করে। শেষে টোবারমরি মারা যায়। তবে বিষ খেয়ে নয়। তার চিরশত্রু রেক্টোরির বড়টমের সাথে লড়াইয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে সে মারা যায়। তবে মানুষের পরচর্চা, সত্যের গোপনীয়তা থেকে নিজেদের মুখরক্ষা করার জন্যে ক্রাইম করার মনোবৃত্তি উন্মোচিত হয়ে রয়ে যায়।

৫) ফ্রাঞ্জ কাফকা, ‘এ রিপোর্ট টু অ্যান অ্যাকাডেমি’।

কাফকার গল্প এবং উপন্যাসগুলি পড়া শেষ করার পরেও আমাদের তাড়িত করে। তাঁর মাস্টারপিস, ‘দ্য মেটামরফোসিস’ সাক্ষী। ‘এ রিপোর্ট টু অ্যান একাডেমি’ লেখা হয়েছিল মার্চ মাসে 1917 সালে। গল্পটি এক প্রাক্তন বনমানুষের দ্বারা প্রদত্ত বক্তৃতার রূপ যে কিনা মানুষের ক্রিয়াকলাপ এবং বক্তৃতা নকল করতে শিখেছিল, এবং সে তার জীবন এবং অভিজ্ঞতাগুলি একদল শিক্ষাবিদদের কাছে রিপোর্ট করেছিল, তারই শিরোনাম, ‘এ রিপোর্ট টু অ্যান অ্যাকাডেমি। ‘
গল্পের বর্ণনাকারী নিজেকে একজন মানুষ হিসেবে  মনে করে বলেছে যে সে পূর্বে একজন বানর ছিল; কিন্তু বিজ্ঞান ব্যবহার করে একজন মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে কথা বলার সময়, সে তার ‘রিপোর্ট’ দর্শকদের কাছে তুলে ধরে বলে যে তার আগের জীবনকে একটি বানর হিসেবে দেখে। সে বর্ণনা করে যে কীভাবে তাকে একটি শিকারির দল গুলি করে বন্দি করেছিল এবং তাকে ইউরোপের উদ্দেশ্যে আবদ্ধ একটি জাহাজে বস্তাবন্দি করেছিল। তারপর সে নিজেকে জাহাজে একটি খাঁচায় বন্দি অবস্থায় দেখতে পায়। সে পালাতে চায়, কিন্তু জানে যে যদি সে সমুদ্রে পড়ে তবে সে ডুবে যাবে। পরে সে সহজাতভাবে বুঝতে শুরু করে যে তার পালানোর সর্বোত্তম সুযোগ হল ক্রুদের আচরণ অনুকরণ করা এবং শেখা। সে যুক্তিসঙ্গতভাবে এটি করার সিদ্ধান্ত নেয়নি, তবে তার ক্রিয়াগুলি এমনভাবে এগিয়ে যায় যেন তার বিকল্পগুলিও বিবেচনাধীন ছিল। সে কেবল তার খাঁচা থেকে পালানোর জন্য যা করতে হবে তাই করেছে। সে শীঘ্রই দেখতে পায় যে সে সহজেই পাইপ ধূমপান করতে পারে, কিন্তু লোকদের পান করা স্নাপ্পসের গন্ধে সে বিতাড়িত হচ্ছিল। যাইহোক, সে পান করতে শিখেছে এবং নিচে রেখে একসময় পুরো বোতলটি পান করেছে লোকদের সামনেই। অবশেষে, বর্ণনাকারী স্বীকার করে যে সে সাংস্কৃতিকভাবে বলতে গেলে একজন গড় ইউরোপীয় হিসাবে পাস করতে পেরেছে। সে আর মনে করতে পারে না যে একসময় বানর ছিল, তাই তার রূপান্তর সম্পূর্ণ। সে বলে যে, সে বাড়িতে একটি কোম্পানির জন্য শিম্পাঞ্জি রেখেছে, প্রায় পোষা প্রাণীর মতো এবং সে যা অর্জন করতে চেয়েছিল তা অর্জন করেছে। কিন্তু একজন মানুষের মতো হয়ে ওঠা কঠিন: যখনই সে মানুষের সামনে বক্তৃতা দিতে যায়, তখনই সে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
বিশ্লেষণ করলে, এই গল্পটি মানব সমাজের কাছে একটি ব্যঙ্গ। ‘সভ্য’ মানুষ হিসেবে বিকশিত হওয়ার মাধ্যমে, আমরা আধুনিক সভ্যতার খাঁচার জন্য প্রকৃতির স্বাধীনতাকে খুন করেছি, যেখানে বেঁচে থাকার সর্বোত্তম উপায়ের জন্যে প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা আমাদের একান্ত দরকার। গল্পটি মানুষের আচরণ সম্পর্কে আকর্ষণীয় প্রশ্ন উত্থাপন করে, এবং ‘বন্য’ আত্মীয়দের সাথে তুলনা করলে মানুষ আসলে কতটা ‘সভ্য’ তা প্রতিফলিত করার জন্য আমাদের আমন্ত্রণ জানায়।
কুকুর নিয়ে কাফকার আরেকটি গল্পও আছে, ‘ইনভেস্টিগেশন অফ অ্যা ডগ’ যে কিনা এক দার্শনিক প্রাণী, যে তার অস্তিত্বের গভীর অর্থে আগ্রহী এবং  যে বিষয়গুলো তার ওপরে এসে পড়েছে তার জন্য যৌক্তিক ব্যাখ্যা খোঁজে।

৬) হোর্হে লুইস বোর্হেস, ‘দ্য রাইটিং অফ দ্য গড’।

আর্জেন্টিনীয় লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেসের (1899-1986) লেখা এটি একটি 1949 সালের ছোট গল্প। গল্পটি একজন মায়ান যাজককে নিয়ে, যিনি একজন জাদুগরও বটে, যিনি বহু বছর ধরে একটি সেলে বন্দী ছিলেন। সেলটি একটি প্রাচীর দ্বারা বিভক্ত, যার অন্য পাশে একটি জাগুয়ার বসে আছে। জাগুয়ারটিও বন্দি। দিনে একবার সিলিং খোলা হয়, যাতে দুই বন্দিকে খাওয়ানো যায়, এবং মুহূর্তের জন্য আলো সেলে প্রবেশ করে এবং বন্দি মানুষ জাগুয়ারকে দেখে। তিনি বুঝতে পারেন যে পশুর ডোরাকাটা প্যাটার্নটির মধ্যেই  ঈশ্বরের বার্তা লেখা আছে। প্রতিদিন সেলের মধ্যে ক্ষণিকের জন্য আলো প্রবেশ করে, এবং প্রতিদিন সে জাগুয়ারটিকে অধ্যয়ন করে এবং ঈশ্বর তাকে কী বলছে তা আবিষ্কার করার চেষ্টা করে। পুরোহিত বুঝতে পারেন যে তার দেবতা জাগুয়ারের চামড়ার মধ্যে জাদু লেখা লুকিয়ে রেখেছেন। অবশেষে ‘দ্য রাইটিং অফ দ্য গড’ বা ‘ঈশ্বরের স্ক্রিপ্ট’ দেখায় কোনো এক জিনিসের মধ্যে যে অসীম, লেখার শক্তি এবং অলৌকিক জ্ঞানের অ্যাক্সেস থাকে তা ফুটে ওঠে জাদুগরের আত্মজিজ্ঞাসার মধ্যেই, “সম্ভবত আমার মুখে যাদু লেখা হবে, সম্ভবত আমি নিজেই আমার অনুসন্ধানের শেষ ছিলাম। সেই উদ্বেগ আমাকে গ্রাস করছিল যখন আমি মনে করতাম যে জাগুয়ার দেবতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য”।

৭) জুলিও কর্টাজার, ‘অ্যাক্সোলটল’।

‘Axolotl’ আর্জেন্টিনার লেখক জুলিও কর্টাজার (1914-84) এর একটি ছোট গল্প। অ্যাক্সলোটল আসলে এক ধরনের মৎস্যজাতীয় প্রাণী যারা জলে থাকে এবং অনেকটা স্যালামান্ডারের লার্ভার মতো দেখতে।  ‘অ্যাক্সলোটল’ গল্পটি একজন একাকী ব্যক্তির দ্বারা বর্ণিত  যিনি নিয়মিত স্থানীয় চিড়িয়াখানায় যান, যেখানে তিনি অ্যাকোয়ারিয়ামের অ্যাক্সোলটলদের দেখে মুগ্ধ হন। চিড়িয়াখানার অ্যাকোরিয়ামে্র অ্যাক্সোলটলদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণরত ব্যক্তিটিকে বারবার দেখে চিড়িয়াখানার টিকিট বিক্রেতা ও রক্ষীরা তাকে পাগল বলে ধরে নেয়।  সময়ের সাথে সাথে, ব্যক্তিটি অনুভব করেন যে তিনি অ্যাক্সলোটলদের একজন হয়ে উঠেছেন। এবং বলে যে তিনিও একজন অ্যাক্সলোটল।
প্রাথমিকভাবে গল্পটি অন্যান্য প্রজাতির সাথে আমাদের সনাক্ত করার ক্ষমতা সম্পর্কে অবহিত করলেও, একটু বিশ্লেষণ করলেই আমরা দেখি অ্যাকোরিয়াম নামক এক সংকীর্ণ জায়গায় অ্যাক্সোলটলদের শান্ত থাকা, জীবনযাপন বা পরস্পরের মধ্যে ঝগড়াঝাটি — এইসব ব্যাপারগুলি আমাদের ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে আবদ্ধ হয়ে ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক নিয়ে বেঁচে থাকার সামিল। তাই ব্যক্তিটির অ্যাক্সলোটল হয়ে ওঠার মধ্যে কোনো  হ্যালুসিনেশন তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না, স্বাভাবিক বলে মনে হয়।

৮) উরসুলা কে. লে গুইন, ‘দ্য ওয়াইফস স্টোরি’।

‘দ্য ওয়াইফস স্টোরি’  একটি ছোট গল্প, 1982 সালে প্রকাশিত। এই ছোট গল্পটি স্ত্রীর দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ভয়ঙ্কর ঘটনা নিয়ে বর্ণিত যা এক গভীর রহস্যে আবদ্ধ। তার স্বামী, যিনি সুদর্শন, ভদ্র, গায়ক, কঠোর পরিশ্রমী, একজন আদর্শ পিতা ইত্যাদি বিভিন্ন গুণ সম্পন্ন, তিনি মাঝে মাঝে কোনো অজুহাত দেখিয়ে রাতে কোথাও চলে যেত। এইসময় তার কণ্ঠস্বর পরিবর্তিত হত এবং তার আচরণও বদলে যেত। ফিরে আসার পরও সে ভিন্ন এক ঘৃণ্য গন্ধ পেত। এই গন্ধ স্নান করার পরেও কয়েক দিন স্থায়ী হত। একদিন তার স্বামী ফিরে আসার পর, তার মেয়ে তাকে লক্ষ্য করে এবং ভয় পায়। পরের বার, পূর্ণিমার চাঁদ রাতশেষে পরিবর্তিত হতে থাকলে সে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখল, খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা এক নেকড়ের লোমগুলি অদৃশ্য হতে ত্থাকল, তার দাঁত, কান পরিবর্তিত হতে হতে এক মানুষের মাংসল মুখ দেখা দিতে শুরু করল। এসব দেখে তার সে ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। গল্পের শেষে দেখা যায় এক মৃতদেহ পড়ে রয়েছে যাকে শিকার করা হয়েছে।
গল্পটা ডঃ জেকিল আর মিঃ হাইডের কথা মনে করিয়ে দেয়। এখানে গল্পটা পাঠককে প্রলুব্ধ করে তার রহস্যের মোড়কতায়। স্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গিতে পাঠককে সীমাবদ্ধ করে এবং ধীরে ধীরে তথ্য প্রকাশ করে গল্পে সাসপেন্স বাড়ায়। নেকড়ে থেকে মানুষে বা মানুষ থেকে নেকড়েতে রূপান্তরের কাহিনিতে একটা পৌরাণিক উপাদানের পাশাপাশি একজন স্ত্রীর চোখে পুরুষের নেকড়েতে রূপান্তরের ঘটনাটা এক সিম্বল হিসেবেও দেখা যেতে পারে।