আনন্দের উল্লাস – সদানন্দ সিংহ

আনন্দের উল্লাস

সদানন্দ সিংহ

প্রতিদিন ফেবু থেকে ফেবুবন্ধুদের জন্মদিনের অনেক নোটিফিকেশান পাই। কিন্তু আমার কাউকে উইশ করতে ইচ্ছে হয় না। করিও না। তা সবাই জন্মদিন পালন করুন, তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। সবাই সবাইকে উইশ করুন, তাতেও আমার কোনো আপত্তি নেই। শুধু আমার ব্যাপারটা অন্যরকম। এক্ষেত্রে আমি একটু কেলাস লোক। আমি নিজেও আজপর্যন্ত কোনোদিন আমার জন্মদিন পালন করিনি। কোনোদিন করতেও চাই না। তাই আমি কাউকে জন্মদিনে এখন আর মনেপ্রাণে উইশ করি না। ভবিষ্যতেও করবো না। এতে হয়তো অনেকে ক্ষুণ্ণ হয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও হবেন। সেজন্যে আমি দুঃখিত। বাচ্চা-কাচ্চাদের কথা অবশ্য আলাদা, ধিঙ্গি লোকদের নিয়েই কথা। এই উইশ না পেয়ে কেউ কেউ আমাকে হয়তো আনফ্রেন্ড করেছেন বা হয়তো করবেন। তাদের কারোর প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। ধরে নিন এক্ষেত্রে আমার চিন্তাটা একটু বেখাপ্পা ধরনের। কারণ আমার কাছে জন্মদিন পালনের কথা মনে হলেই পাশাপাশি মৃত্যুদিনের কথাও সামনে এসে পড়ে। আমার কাছে জন্মদিন পালন মানেই আমাদের ক্রমহ্রাসমান আয়ুর তালুয় হাত বোলানো।
আমাদের বায়োলজিকাল ফাংশনের একদিন শেষ আছে। এটা আমরা ভুলে যাই। মৃত্যু ব্যাপারটা একদিন আমিও জানতাম না। সেটা মা আমাকে বলেছিলেন আমার সাত-আট বছর বয়সে। প্রথমে ঠিক বিশ্বাস করিনি। শুধু প্রশ্ন করেছিলাম, কেন এমন হবে ? মা আমাকে ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারেননি, বলেছিলেন, এটাই জগতের নিয়ম। কিছুদিন পরে পাড়ার কেউ একজন মারা গেছিলেন। মৃতদেহটাকে শ্মশানে নিয়ে যাবার সময় মা আবার আমাকে দূর থেকে দেখালেন, ঐ দেখো, একজন মারা গেলেন। এখন দাহ করার জন্যে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
চোখের সামনে প্রথম মৃত্যু দেখেছিলাম দাদুর। তখন আমার বয়স চৌদ্দ কি পনেরো। দাদুর বয়েস হয়েছিল নব্বইয়ের কাছাকাছি। ঐ বয়সে দাদুর স্বাস্থ্য ছিল একদম ফিট। রাজপাট গেলেও মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত দাদু ছিলেন ত্রিপুরার মহারাজার রাজপ্রাসাদের ফুলবাগানের কর্মচারি। বহুবছর ধরে ভারতের স্বাধীনতার অনেক আগে থেকেই এই ফুলবাগানের চাকরিটি তিনি করে গিয়েছিলেন। দাদু একটু রাগী ছিলেন, এছাড়া আর কোনো অস্বাভাবিকতা আমি দেখি নি। আর হ্যাঁ, দাদু ঈশ্বর-ভূতপ্রেত-পরাবাস্তবে বিশ্বাসী ছিলেন। আমি অনেকদিন চুপিচুপি দাদুর পেছনে লুকিয়ে শুনেছি, দাদু অশরীরী কারুর সঙ্গে বিভিন্ন আলাপ করছেন। না, আমি তখন দাদুর সামনে কাউকে দেখিনি। সেই দাদুর একদিন ব্রেন স্ট্রোক হল। বাবা তখন বাড়ি ছিলেন না, অনেক দূরে এক মফস্‌সলে সরকারি চাকরি করতেন। আমি বড় ছেলে। আমিই পাড়ার কমলকাকুকে ডেকে আনলাম। কমলকাকুর মেয়ে ছিল আমার সহপাঠিনী। আমি আর কমলকাকু দাদুকে জিবি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। হাসপাতালে সঙ্গে সঙ্গে দাদুকে একটা বেডে পাঠানো হল। ডাক্তার এলেন আর একটা ইঞ্জেকশান দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে দাদু ঘুমিয়ে পড়লেন। সেই ঘুম আর ভাঙলো না। পরদিন আমার চোখের সামনেই দাদুর নিঃশ্বাস হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। দাদুর মুখাগ্নি আমার হাতেই হল। এখনো আমার মনে হয় দাদুর সঙ্গে আমার অনেক পরিচয়ের বাকি রয়ে গেছে। দাদুকে নিয়ে আমার অনেক লেখার আছে। তবে দাদুর এক বন্ধুকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছিলাম, “শিকাচাও বৃত্তান্ত”।
জটিল রোগ বা মানসিক ডিপ্রেশান ছাড়া মধ্যবয়েসের আগে সত্যিই মৃত্যুর কথা কেউ চিন্তাও করে না। সেটাই স্বাভাবিক। সারাজীবন আমরা সংসারের আবর্তে, এক চাওয়া-পাওয়ার আবর্তে ভেসে চলি। অযথা টেনশনে ভুগি। শেষ বয়সের দিকে টের পাই, আমাদের জীবনটা ক্ষণস্থায়ী। মনে হয়, এই তো কিছুদিন আগে যেন শৈশব পার করে এসেছি। মাথার মধ্যে তাই এখন কয়েকটি শব্দ শুধু ঘোরাঘুরি করে – “ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ, যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ”। তাই “হ্যাপি বার্থ ডে” বলার চেয়ে সবার সুখ কামনা করি। কামনা করি সবাই শেষদিন পর্যন্ত অপার আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকুন এবং এক সুনাগরিকের মন নিয়ে আনন্দের উল্লাসে ফেটে পড়ুন।