কিচিরমিচির – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

কিচিরমিচির     (ছোটোদের গল্প)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

রিন্টুদের বাড়ি থেকে ফিরেই খাঁচার সামনে এসে দাঁড়ায় টিপু। ভীষণ মন খারাপ। একমনে দেখতে থাকে পাখিগুলোকে। কেমন একটা ভয় ছায়া ফেলেছে টিপুর মনে। মুখেও।

নানা রঙের ছোটো ছোটো পাখি। ছয়টা।
সেদিন খাঁচায় পাখি নিয়ে বিক্রি করতে এসেছিল একজন লোক। সেই দেখে শুরু হয় টিপুর বায়না, তারও পাখি চাই। কান্নাকাটি করেছিল খুব। মা-বাবা দুজনেই বলেছিল টিপুকে, পাখি খাঁচাতে ভীষণ কষ্ট পায়। ওদের আনন্দ আকাশে। কথা শোনেনি টিপু। বরং কান্নার তোড় বেড়েছিল আরো। বাধ্য হয়েই পাখিগুলো কিনে এনেছে টিপুর বাবা। ভেবেছিল, পরে টিপুকে বুঝিয়ে উড়িয়ে দেবে সব পাখি। পাখি দেখে টিপুর মা খুশি হয়নি মোটেই। তবে টিপু ভীষণ খুশি।

স্কুল, পড়া, খেলাধুলা এর ফাঁকে যখনই সময় পায় খাঁচার সামনে এসে চুপটি করে দাঁড়ায় টিপু। পাখিদের নানা রঙ্গ দেখে ভীষণ মজা পায়। তবে ছোট্ট একটা অভিযোগ আছে টিপুর। পাখিগুলো কেমন ভাবে যেনো ডাকে। কিচিরমিচির করে না তো! অথচ জানালার সামনেই গাছটায় কত পাখি এসে বসে সারাদিন। শুধুই কিচিরমিচির। টিপু ভাবে ওদের যেনো একটাই কথা কিচিরমিচির।
সে জিজ্ঞাসা করে মাকে, “মা কিচিরমিচির মানে কি?”
মা বলে, “কি করে বলবো সোনা, আমি কি পাখির কথা বুঝি?”
চুপ করে থাকে টিপু। পরক্ষণেই আবার প্রশ্ন, “মা আমার পাখিগুলো কিচিরমিচির করে না কেন? “
মা বলে, “মনে হয় ওরা কষ্ট পায় খাঁচায়, তাই।”
টিপু বলে, “না না, ওদের আবার কিসের কষ্ট? দানা খাচ্ছে, রোদবৃষ্টির ভয় নেই। ওরা তো ভালই আছে।”
মা বলে, “না টিপু, ওদের কষ্ট হয়। তুমি বুঝতে পারো না।”
মায়ের কথায় মন ভরে না টিপুর। ওরা কিচিরমিচির করে না কেন? ঘুরে ফিরে প্রশ্নটা নাড়া দিয়ে যায় টিপুকে। রিন্টুকে সেদিন জিজ্ঞাসা করেছিল স্কুলে। রিন্টু বলে, না রে, আমাদের পাখি দুটোও কিচিরমিচির করে না। মনে হয় ওরা বিদেশি পাখি তো। তাই।
আজব ব্যাপার! দেশ বিদেশের পাখির ভাষাও আলাদা হয় নাকি!

খাঁচার সামনে আনমনে দাঁড়িয়ে টিপু।
“কি হলো টিপু? শরীর খারাপ লাগছে?” জিজ্ঞাসা করে টিপুর মা। টিপুর মুখে কথা নেই। দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে জানান দেয় শরীর খারাপ নয়।
“বন্ধুরা কিছু বলেছে?”
“না।” মাকে বলে টিপু।
“মন খারাপ?”
চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে টিপু।

আজ রিন্টুর জন্মদিন। মায়ের সঙ্গে রিন্টুদের বাড়ি গিয়েছিল টিপু। বন্ধুদের সঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে বাড়ি এসেছে একটু আগেই। তারপর থেকেই আনমনা।
মা এসে দাঁড়ায় পাশে। জানালার বাইরে হেঁটে চলে টিপুর দৃষ্টি। রোদ ঝলমলে আকাশ। ডানা মেলে উড়ে বেড়ায় কত পাখি। একমনে দেখে টিপু।
মা হাত বুলিয়ে দেয় টিপুর মাথায়। স্নেহের পরশ। “কি হয়েছে টিপু সোনা?”
দুই চোখের কোল চিকচিক করে ওঠে টিপুর। ছেলেকে আদর করে মা। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে টিপু। বলে, “পাখিগুলো উড়িয়ে দেব মা?”
“কেনো!”
“ওদের কষ্ট হয় খাঁচায়।”
“কি করে বুঝলে?”
“জানো মা রিন্টুদের…” ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে টিপু। শেষে অনেক কষ্টে মনের কথা মাকে বলে।
রিন্টুদের বাড়িতেও পাখি আছে। একজোড়া বদ্রী পাখি। একটা উড়ে পালিয়েছে কিভাবে যেনো। তারপর থেকে অন্য পাখিটা দানা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বসে থাকে চুপ করে। রিন্টু ভয় পায় যদি এই পাখিটা না খেয়ে খেয়ে…।

“উড়িয়ে দেবো মা?” সজল চোখে জিজ্ঞাসা করে টিপু।
মা হাসে টিপুর কথা শুনে।
বারান্দায় গিয়ে খাঁচার দরজা খুলে দেয় টিপু। একে একে সব পাখি ডানা মেলে আকাশে। কিচিরমিচির করতে করতে উড়ে যায় দূরে, বহু দূরে। আনন্দে ভরে ওঠে ছোট্ট টিপুর মন। চিৎকার করে ওঠে কিচিরমিচির বলে। মাকে বলে, “জানো মা, কিচিরমিচির মানে হল আনন্দ। খুউব আনন্দ।”
খুশিতে ছেলেকে কোলে তুলে নেয় টিপুর মা। টিপু বলে, “মা, রিন্টুর বাড়িতে ফোন করে বল না ওদের একলা পাখিটাকে উড়িয়ে দিতে। খুব কষ্ট পাচ্ছে পাখিটা।”
টিপুর মা ফোন করে রিন্টুর মাকে। মায়ের হাত থেকে ফোনটা নেয় টিপু। বলে, “আন্টি, পাখিরা খাঁচায় খুব কষ্ট পায়। তোমাদের ওই পাখিটাকে উড়িয়ে দাও। ও ঠিক নিজের বন্ধুকে খুঁজে নেবে।”
ফোনটা মায়ের হাতে দিয়ে দৌড়ে বারান্দায় যায় টিপু। চেয়ে দেখে আকাশটাকে। পরক্ষণেই মাকে ডাকে হাত নেড়ে। চাপা গলায় বলে, “চুপ। শব্দ না করেএসো।”
ছেলের ডাকে বারান্দায় আসে মা। বলে, “কি?”
টিপু বলে, “ভালো করে শোন।”
“কি?”
মায়ের কানের কাছে মুখটা নিয়ে এসে টিপু বলে, ” কিচিরমিচির কিচিরমিচির।”