আমি অভিমন্যু – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

আমি অভিমন্যু          (অনুগল্প)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

আমি অভিমন্যু। তরবারির এক এক আঘাতে শেষ করে ফেলবো হাজার হাজার শত্রু। হাতের লাঠি নাচিয়ে বীরদর্পে আস্ফালন করে ছোট্ট পাকু। অনন্তবাবুর ঘর আজ কুরুক্ষেত্র প্রান্তর। চক্রব্যূহের রথী-মহারথীরা নাস্তানাবুদ পাকুর শৌর্যের সামনে। ঘরের একপাশে পড়ে রয়েছে বইখাতা। যুদ্ধে মত্ত পাকু।
বিছানায় শুয়ে অনন্তবাবু। দেখছেন বাচ্ছা ছেলের খেয়ালি কাণ্ড।

কয়দিন ধরে বেসুরে বেজেছে শরীর। বুকে চিনচিনে ব্যথা। মনটা ভালো নেই। শচীদার মৃত্যু অসহনীয়। দিন পনেরো হলো মারা গেছেন শচীবাবু। অনন্তের পড়শী। রোজ সকাল দুপুর শচীদার সঙ্গে গল্প গুজবে পেরিয়ে যেতো সময়ের প্রহরগুলি। অনন্ত এখন একা। কর্মহীন জীবনে শুন্যতা অফুরান। মৌন্যতায় মুখর প্রহরের তরঙ্গগুলি মনে করিয়ে দিয়ে যায় নির্মম একাকীত্ব। তারই মাঝে মরূদ্যান পাকুর প্রভাতী যুদ্ধের আসর।
রোজ সকালে সুধার সঙ্গে অনন্তবাবুর বাড়ি আসে পাকু। সুধা ব্যস্ত থাকে রান্না আর ঘরদোর গোছগাছ করার কাজে। মায়ের ব্যস্ততার সুযোগে লাঠি হাতে কল্পলোকের শত্রু নিধনে ব্যস্ত থাকে বীরযোদ্ধা পাকু। শত্রু যেই হোক পাকু অজেয়। দেখতে বড্ড ভালোলাগে অনন্তবাবুর। ইচ্ছে যায় পাকুর তরবারির আঘাতে মুছে যাক তার জীবনের একাকীত্বের যন্ত্রণা।

– পাকু, পড়ছিস? রান্না ঘর থেকে বলে সুধা।
মুহূর্তে শৌর্যহীন পাকু। হাতের তলোয়ার খসে পড়েছে। মায়ের ভয়ে সরস্বতীর চরণে মনোনিবেশের প্রচেষ্টা এইবার।
চা নিয়ে ঘরে আসে সুধা। অনন্তবাবুর বুকের ব্যথা নিয়ে চিন্তিত সে। বলে, তুমি আর একলা এখানে থেকো না কাকু। দেখলে তো শচীকাকু কি কাণ্ড ঘটালো। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে চলে যায় সুধা।
এই এক যন্ত্রণা। ইদানীং সবাই পরামর্শ দেয় অনন্তকে মেয়ের কাছে গিয়ে থাকতে। আজ সকালে এসেছিল ডাক্তার সেন। বলে অনেক হলো অনন্তদা। শচীদা যে কাণ্ড বাঁধালো। আপনি আর একা থাকবেন না। ভয় হয় আমাদের। এইবার মেয়ের কাছে গিয়েই থাকুন।
রাতদিন এমন কথা শুনে নিজের উপর বিশ্বাসটাই টলমল করে মাঝে মধ্যে।
– আমি গেলাম দাদু। কাল এসে তরবারিটা নেবো আবার। তোমার কাছেই রেখে দাও। সুধার সঙ্গে চলে গেলো পাকু।

চৈত্রের দুপুর। নিঃসাড়ে পুড়ছে প্রকৃতি। ঘরে একলা অনন্ত। জানালা টপকে দৃষ্টি গিয়ে পড়ে শচীদার ঘরে। কেঁপে ওঠে বুক। অনন্তর চারপাশে কারা যেনো বলে, তুমি আজ একা অনন্ত। দিনের আলোয় ঘরের চেনা বস্তুগুলো হয়ে ওঠে অচেনা। এক অজানা ভয় হাত বাড়িয়ে দেয় অনন্তর দিকে। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় অনন্ত। তাকিয়ে থাকে দেওয়ালের আয়নার দিকে। একি! এতো শচীদার প্রতিকৃতি। দু পা পিছিয়ে আসে অনন্ত। পাখার ঘূর্ণনে ঘরের ঘূর্ণি-বাতাস ফিসফিসিয়ে বলে, একা-একা তুমি অনন্ত। এইবার কোথায় যাবে ?

নিজেকে প্রস্তুত করে অনন্ত। বিছানার উপর থেকে হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় লাঠিটা। পাকুর তরবারি। লম্বা শ্বাস নেয় একটা। একাকীত্বের কাছে হার মানবে না কিছুতেই। শক্ত হয়ে ওঠে চোয়াল। আয়নায় শচীদার প্রতিকৃতি ভেঙে খানখান হয়ে যায়। ফুটে ওঠে অনন্তর মুখ। একদম অন্যরকম দেখতে লাগছে নিজের প্রতিকৃতি। কুরুক্ষেত্রের যোদ্ধা অনন্ত। বন বন করে তলোয়ার ঘোরায়। অনন্ত আজ অজেয় হতে চায় পাকুর মত। একাকীত্বের চক্রব্যূহ ভেদ করবেই। অসীম ক্রোধে চিৎকার করে অনন্ত। বলে, “আমি অভিমন্যু। আমি আজ অপরাজেয়।”