বিনতা, ইউরেনাস ও বুলবুলি – বিজয়া দেব

বিনতা, ইউরেনাস ও বুলবুলি        (ছোটোগল্প)

বিজয়া দেব

বুলবুলিটা ছাদে কাপড় শুকনোর স্ট্যান্ডটার মাথায় বসতে ভালবাসে। কখনও একা কখনও তার সঙ্গীকে নিয়ে এসে বসে। খুব চঞ্চল। কাছে গেলেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। এদিকে কাকেদের ভ্রূক্ষেপ নেই। ওদিকের ছাদটায় পোদ্দার দাদু কাকেদের খাবার দেয় ভোরবেলায়। সেজন্যে ওদের ওড়াওড়ি থাকেই। ওরা মানুষকে পরোয়া করে না মোটেই। কাছে গিয়ে হাততালি দিলে ফুড়ুৎ করে উড়ে গিয়ে অল্প দূরে গিয়ে বসে। পায়রাগুলোও তেমনি। তিতিরের পায়ে পায়ে ঘোরে বলতে গেলে। গলা ফুলিয়ে বকম বকম করে, খুব হাসি পায় তিতিরের।

সব পাখির নাম জানে না তিতির। এই ছাদে পাখি আসে নানারকম। একটি ছটফটে পাখিকে দেখে বিনতাকে জিজ্ঞেস করেছিল – এটা কি পাখি বিনতামাসি? বিনতা তখন ছাদ ঝাঁট দিচ্ছে। খুব তাড়া ওর। আরও সাতটা বাড়িতে কাজ করে।
বলল – কোনটা?
– ঐ যে।
বিনতা চলে যাবে এক্ষুনি। জানে তিতির।
শশব্যস্তে বলে – একটু মুখ তুলে তাকাও না!
বিনতা ঘোর অসন্তোষ নিয়ে হালকা একটু মাথা তুলে দেখল কি দেখল না, বলল – টুনটুনি।
তিতির ভাবল – যাহোক ভুল বা ঠিক, সে এই পাখিকে টুনটুনি বলেই চিনবে আপাতত। এটা ভাবতে না ভাবতেই আরও একটা ছোট্ট পাখি এল। বিনতাকে আবার জিজ্ঞেস করতেই সে উত্তর না দিয়ে নেমে গেল। তার ঝাঁট দেওয়া হয়ে গেছে।
বিনতাকে নিয়ে ভাবতে বসল তিতির। আচ্ছা! এরকম মানুষ হয়? কোনও জিজ্ঞাসা নেই। শুধু কাজ করেই যাচ্ছে করেই যাচ্ছে। ঝাঁট দিচ্ছে তো দিচ্ছে, একবার চোখ তুলে তাকানো যাবে না? কী অদ্ভুত। অথচ বিনতামাসি জানে। একবার বাড়ি থেকে পিকনিক হয়েছিল। বিনতামাসিকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দেখা গেছে সে গাছপালার নাম পাখির নাম খুব জানে।
পরেরদিন সকালবেলায় তিতির বিনতাকে খুব মন দিয়ে লক্ষ করল। অদ্ভুত ক্ষিপ্রতা তার কাজে। আজও সকালবেলায় ছাদে ছোট ছোট দুটো পাখি ছিল। ঠোঁটদুটো অল্প বাঁকানো। বিনতাকে একটু জিজ্ঞেস করে নিলে কেমন হয়? বিনতা তাকে কাছাকাছি ঘুরতে দেখে যেন আরও ক্ষিপ্র হল। এর ফাঁকেই জিজ্ঞেস করল তিতির – বিনতামাসি, তুমি তো পাখি চেনো খুব, তাই না?
বিনতা ঘাড় নেড়ে বলে – বিকেলে। বিকেলে বলব তোমায়, কেমন?
– বেশ।
বিকেলে বিনতা এল না। অনেক অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে তিতির পড়তে বসল।

রাতে স্বপ্নে এল বিনতামাসি। মাথায় একটা বহু মূল্যবান রত্নখচিত মুকুট। বলল – কহ বৎসে, কী জানিতে চাও?
তিতির অবাক হয়ে দেখছিল বিনতামাসিকে কী সুন্দর লাগছে। মাথার মুকুটটি থেকে অপূর্ব দ্যুতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। এবার সে লক্ষ করল চারপাশে ঘনঘোর অন্ধকার। বিনতার দেহ থেকে ও মাথার মুকুট থেকে বিচ্ছুরিত আলোর ভেতর তিতির দেখতে পেল এক অবিমিশ্র বিশৃঙ্খলা মানে একটা “ক্যাওস” । এই “ক্যাওস” থেকেই তো “কসমস” শব্দটি এসেছে। অনেক গ্রহ গ্রহাণু নক্ষত্র ছায়াপথ এক বিশৃঙ্খল আবহের ভেতর ছুটছে দ্রুতগতিতে।
এদের মাঝ থেকে উড়ে এল একটি বুলবুলি। ওটা উড়ে গিয়ে বসল বিনতার হাতে আর মানুষের ভাষায় কথা বলে উঠল।
বলল – ইনি তোমার বিনতামাসি নন। ইনি হচ্ছেন দেবী ‘গায়া’ আর এই যে অন্ধকার দেখছ এইটি হচ্ছে ‘ওরানোস’ মানে তোমাদের আকাশ। এই যে সূর্য ওঠে ঝড় বৃষ্টি ভূমিকম্প হয় সব এই দেবী “গায়া”ও দেবতা “ওরানোসে”র কাজ। এইসব কিছু ওরাই করে থাকেন। এঁকে বলতে পারো পৃথিবীর দেবী। তোমার সেই ছোট্ট ছোট্ট পাখিগুলোর নাম ইনি জানেন। শুধু তোমার পাখি কেন নদনদী গাছপালা মানে তোমাদের দুনিয়ায় যা কিছু আছে সবকিছুই দেবীর নখদর্পণে। আর এই ঘনঘোর অন্ধকারের বিশৃঙ্খলার মাঝে জেগে আছেন আকাশের দেবতা “ওরানোস”। ইনিই আমাদের মানে পাখিদের নিজের ভেতর স্থান দিয়েছেন। এজন্যে দেবী গায়া কান্নাকাটি করায় দেবতা ওরানোস বললেন – ঠিক আছে তোমার গাছপালা মাটি মানে ধরিত্রীর হেথা হোথা ওরা বসবে কিন্তু উড়বে আমার বুকে মানে আকাশে।
– আচ্ছা “ওরানোস” থেকে কি ইউরেনাস?
– ও তোমরা বলতে পারো। তোমাদের মানে মানুষদের তো একটা সূত্র পেলেই হল কীসে থেকে কীসে হয়ে যায়।
– কিন্তু ইউরেনাস তো একটা গ্রহ।
– ঐ হল আর কি! “ওরানোস” মানে আকাশ। এই “ওরানোস” নাম থেকে একটি একটি গ্রহের নাম দেওয়া হয়ে গেল “ইউরেনাস” । ওরানোসকে ইউরেনাস মানিয়ে দেওয়া হল।  বলে বুলবুলি হাসতে লাগল।

ঘুম ভেঙে গেল তিতিরের। অসাধারণ স্বপ্ন। কেন এমন স্বপ্ন দেখল সে? ও হ্যাঁ মাথার কাছে একটা বই। ঘুমোবার সময় একটু পড়েছিল। একটি অনুবাদ গ্রন্থ। “পুরাণের কথা”,লেখক আইজাক আসিমভ। অনাদি অনন্ত অন্ধকারের আদিম বিশৃঙ্খলা থেকে পৃথিবী ও জীবজগতের সৃষ্টি। গ্রিক পুরাণের গল্পে আছে ধরিত্রীর দেবী “গায়া” ও আকাশের দেবতা “ওরানোসে” র মিলনে পৃথিবীর জীবজগতের উৎপত্তি। আর ঐ আদি বিশৃঙ্খলা? অনেক প্রশ্ন আছে। অনেক কথা আছে ভাববার।
তবে আজ স্বপ্নে যা দেখল তিতির তা অতুলনীয়, তা অসাধারণ।

পরদিন বিনতা যখন দ্রুতবেগে কাজ সারছে তখন মনে হল এই – ই দেবী। “গায়া” কিনা সে জানে না। তবে এত কাজ যে এত দ্রুতবেগে একহাতে করতে পারে সে দেবী ছাড়া আর কি! এই যে বাসনকোসনগুলো ঝকঝকে করে মেজে দিয়ে যায় কিংবা ঘরের ভেতরটা, ছাদটা পরিচ্ছন্ন করে ঝাঁট দিয়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি কৈ তাদের বাড়ির কেউ তো তেমনটা পারে না! এত পরিচ্ছন্ন শৃঙ্খলা এনে দিতে পারে বিনতামাসি। । কিন্তু ওর বেশবাস এত দীন কেন? ওর জীবনে যেন কসমসের সেই আদিম অকৃত্রিম বিশৃঙ্খলা।

বিনতা কাজ করতে করতে মুখ তুলে হাসল। বলল – কি গো তিতির? আমার পেছন পেছন হাঁটছ? তোমার ঐ পাখিগুলো? ওগুলো ফিঙে।