মাটির বাড়ি হারিয়ে যাচ্ছে – সুদীপ ঘোষাল

মাটির বাড়ি হারিয়ে যাচ্ছে

সুদীপ ঘোষাল

পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার অন্তর্ভুক্ত আমার গ্রামে মাটির বাড়ির আধিক্য বেশি ছিল। কিন্তু অজয় ও ঈশানীর জলে বন্যা হলে বর্ষাকালে এইসব অঞ্চলে মাটির বাড়ি ভেঙে পড়ে। নতুন বাড়ি করতে গেলে বাড়ির মালিক ধার দেনা করে পাকা বাড়ি গড়ে তোলেন। বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মাটির বাড়ি খুব কম দেখা যায়।

কিছু কিছু জায়গায় দোতলা ঘরের পাশাপাশি প্রত্যেকেরই একটি করে একতলা মাটির ঘর রয়েছে। কেউ কেউ দোতলায় বসবাস করেন আবার কেউবা দোতলায় ধান সংরক্ষণ করেন। এ ছাড়া আরেকটি কারণে এ এলাকায় মাটির দোতলা ঘর তৈরি করা হতো। এর কারণ হলো এ অঞ্চলে, এক সময় খুব বেশি ডাকাতি হতো বলে বিত্তশালীরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করে মাটির তৈরি দোতলা ঘর তৈরি করে দ্বিতীয় তলায় তারা বসবাস করতেন। চাপা দুয়োর থাকত দোতলায়,মাথার ওপরে।লাফিয়ে একজন আগে উঠে ছোটোদের টেনে তুলতেন। তারপর চাপা দুয়োরে খিল দিতেন। ডাকাত এলেও চাপা দরজা ভাঙতে পারত না।

এই মাটির ঘর ঠান্ডা থাকায় এক সময় এটাকে গরীবের এ সি ঘরও বলা হয়। এ ঘর গরমের সময় আরামদায়ক। তাই অনেক গ্রামেই বিত্তশালীদেরও দোতলা মাটির ঘর ছিল। এখনও এ অঞ্চলের অনেক গ্রামে রয়েছে মাটির ঘর।

তবে, এই জেলায় সাম্প্রতিক বন্যায় এসব মাটির ঘরের বেশিরভাগই ভেঙে গেছে। যেগুলো আছে তার মধ্যে ফেটেও গেছে বেশ কিছু। এ নিয়ে চিন্তিত অনেকে। কিন্তু দরিদ্র পরিবারগুলোর ভরসা ওই মাটির ঘরই।

মাটির সহজলভ্যতা, এর প্রয়োজনীয় উপকরণ আর শ্রমিক খরচ কম হওয়ায় আগের দিনে মানুষ মাটির ঘর বানাতে বেশি আগ্রহী ছিল। মাটির ঘর যাদের আছে তারা প্রতিবছরই মাটির প্রলেপ দেয়। অনেকে আবার চুনকামসহ বিভিন্ন রংও করেন। মাটির বাড়ির মধ্যে ছিটেবেড়া, বারেন্দাকোটা বাড়ি, টিনের চালের বাড়ি, খড়ের চালের বাড়ি, এসব রকমের মাটির বাড়ি দেখা যায় এখনও।

অতি প্রাচীনকাল থেকেই এ দেশের গ্রামগঞ্জে মাটির বাড়ির প্রচলন ছিল। গ্রামের মানুষের কাছে মাটির বাড়ি ঐতিহ্যের প্রতীক ছিল। গ্রামের বিত্তশালীরা অনেক অর্থ ব্যয় করে মাটির দোতলা মজবুত বাড়ি তৈরি করতেন। যা এখনও কিছু কিছু এলাকায় চোখে পড়ে। মাটির তৈরি একতলা ও দোতলা বাড়িগ্রামের প্রতিটি বাড়িতে একটি করে একতলা ও দোতলা মাটির ঘর রয়েছে। ইউনিয়নটির সব বাড়িতেই সারিবদ্ধ মাটির ঘর দেখা গেছে। কোনো কোনো বাড়ির এসব মাটির ঘরে বিভিন্ন রকমের আলপনা এঁকে ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। এঁটেল বা আঠালো মাটি কাদায় পরিণত করে ৩-৪ ফুট চওড়া করে দেয়াল তৈরি করা হয়। একতলা মাটির বাড়ির জন্য ১২ থেকে ১৪ ফুট উঁচু দেয়ালে কাঠ-বাঁশ অথবা লোহার এঙ্গেল দিয়ে সিলিং তৈরি করে তার ওপর টিনের ছাউনি দেওয়া হয়। আর দোতলা বাড়ির জন্য ১৩ থেকে অন্তত ২৫ ফুট উঁচু দেয়াল তৈরি করে ১৩ ফুটের মাঝে তালের গাছের ফালি দিয়ে পাটাতন তৈরি করে দুই থেকে তিন ইঞ্চি মোটা কাঠের ছাউনি দেওয়া হয়। আর ২৫ ফুটের মাথায় একতলা বাড়ির ন্যায় টিনের ছাউনি দেওয়া হয়। মাটির বাড়ির মালিকদের দাবি, ভূমিকম্পেও মাটির ঘরের খুব বেশি ক্ষতি হয় না। একেকটি মাটির ঘর এক থেকে দেড়শ’ বছরেরও বেশি স্থায়ী হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান সময়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় আর কালের পরিক্রমায় গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এসব মাটির বাড়ি ইট-বালির দালান-কোঠা আর বড় বড় অট্টালিকার কাছে হার মানছে। সাধারণত এঁটেল বা আঠালো মাটি দিয়ে জলের সঙ্গে মিশিয়ে কাদায় পরিণত করা হয়। এরপর ২০/৩০ইঞ্চি চওড়া দেয়াল তৈরি করা হয়। প্রতিটি ঘর তৈরি করতেও মাসখানেক সময় লেগে যায়। কারণ একেবারে দেয়াল তোলা যায় না। কিছু দেয়াল তোলার পর শুকাতে হয়। ১০/১৫ ফুট উচু দেয়ালে কাঠ বা বাঁশের সিলিং তৈরি করে তার উপর খড় বা টিনের ছাউনি দেওয়া হয়। তার দ্বিতল মাটির বাড়ি এখনও রয়েছে। এ গ্রামে অনেকের এই মাটির ঘর আছে। অনেকে বাঁশ, মাটি, টিন সংগ্রহ করে নিজেরাই মাটির ঘর তৈরি করেন। এক্ষেত্রে সময় বেশি লাগে।

তবে ডিজিটাল যুগে সবই আধুনিক হচ্ছে। মাটির বাড়ির পোতা ইট দিয়ে বাঁধানো হচ্ছে। মাটির বাড়ির পাশে ইটের পাকা বাড়ি বা চায়না প্লেটের বাড়িও হচ্ছে।