জীবন আর যৌবন — সদানন্দ সিংহ

জীবন আর যৌবন

সদানন্দ সিংহ

খাটা পায়খানা। নিচে মাটির গর্ত। গর্তটা বিষ্ঠায় ভর্তি এবং ওপর থেকে এসব দৃশ্যমান। পায়খানার বাঁশের বেড়ার আড়ালে বসে বেড়ার ফাঁকে জীবন অনেক দূর-দূরান্তের গাছ-বাড়িঘর-ধানক্ষেতের দৃশ্য দেখতে দেখতে পেট পরিষ্কারের চেষ্টা করে আধঘন্টা যাবৎ। পেট ঠিকভাবে পরিষ্কার না হলে তার মেজাজটাও ঠিক থাকেনা।

প্রথম প্রথম এখানে খুব অসুবিধে হয়েছিল জীবনের। সরকারি চাকুরিসীমা বয়েসের শেষপ্রান্তে কার্গিল যুদ্ধজয়ের মতো কপালে শিকে ছিঁড়ে কৃষিবিভাগের নতুন চাকরি পেয়ে সে যখন এই অজ গ্রামে পোস্টিং পেল, তখন সে বেশ খুশিমনেই এখানে চলে এসেছিল। গ্রামের একজন প্রাইমারি স্কুলশিক্ষকের বাড়িতে ঘরভাড়া নিয়েছিল। মাটির ঘর। ওপরে টিনের চাল। থাকার জায়গা হিসেবে মন্দ নয়। শুধু মুশকিল হচ্ছে এই খাটা পায়খানাটা। প্রথম দিন তো এই খাটা পায়খানায় ঢুকেই বিষ্ঠাকুণ্ড দেখে বেরিয়ে এসেছিল। তিন-চারদিন সে তাগিদটা চেপে রেখেছিল। তবে প্রয়োজনের তাগিদে এবং বেঁচে থাকার জন্যে পৃথিবীর অনেক কিছুই গা-সহা হয়ে যায়। জীবনেরও আস্তে আস্তে তা হয়ে গেছে।

শৌচকর্ম শেষ করে জীবন বেরিয়ে আসতেই সে দেখে একটু দূরে মালতি জলভর্তি প্লাস্টিক বালতিহাতে দাঁড়িয়ে তার বেরিয়ে আসার অপেক্ষা করছে। জীবন একটু অপ্রস্তুত হয়, মেয়েটা কতক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কে জানে। সাতজন লোকের জন্য পায়খানা একটাই।
আসলে মালতি ছোট্ট মেয়ে নয়, বয়েস প্রায় কুড়ি। বাড়ির মালিকের ছোটবোন এবং বারবার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েও উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তবে সে জীবনকে খুব পছন্দ করে। জীবনও টের পায়, মালতি তার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরির চেষ্টায় আছে। জীবন ব্যাপারটাকে তেমন একটা আমল দেয়নি।
জীবনকে এগিয়ে আসতে দেখে মালতি আপনমনে ফিকফিক করে হেসে পায়খানার দিকে এগোয়। মালতির হাসি দেখে জীবন বুঝতে পারে মালতি অনেকক্ষণ ধরেই দাঁড়িয়ে ছিল।

টিউকলে সাবান দিয়ে ভালো করে হাত-মুখ-পা ধুয়ে জীবন যখন ঘরে ঢোকে তখন সে দেখে তার ঘরের মাটির মেঝে ঝকঝকে পরিষ্কার হয়ে গেছে, বিছানা পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। যাক সরস্বতী এসে গেছে। রান্নাঘরে একটু উঁকি মারে জীবন। জীবন দেখে, সরস্বতী রান্না শুরু করে দিয়েছে।

গ্রামে যাবার আগে মা পইপই করে জীবনকে বলে দিয়েছিল, রান্নার জন্যে একজন বয়স্কা মহিলা রাখিস। আর বাড়ির মালিক কিনা যাকে ঠিক করে দিল সে একজন পচিশ বছরের পরিপূর্ণা মহিলা, কিন্তু বেশ রোগা। তারই নাম সরস্বতী। স্বামী পরিত্যক্তা এবং সন্তানহীনা যে জীবনের জন্যে দুবেলা এসে রান্না করে চলে যায়।
সরস্বতী গ্রামেরই কোনো এক চাষীর মেয়ে। প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারেনি, হয়তো অর্থাভাবে। অল্পবয়সে একবার বিয়ে হয়েছিল তার। প্রায় দু’বছর আগে নাকি তার স্বামী তাকে ফেলে কোথাও চলে গেছে। তাই এখন সে বাপের বাড়িতেই থাকে। তবে সরস্বতীকে জীবনের ভালোই লাগে। মুখশ্রী সুন্দর, শ্যামলা এবং কাজেকর্মে সবসময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। শুধু রান্না নয়, সকালে চা-জলখাবারের ব্যবস্থাও করে, ঘরদোর সাজায় এবং পরিষ্কার করে, বাসন মাজে, মিষ্টি করে হাসে।
সরস্বতী বেশ চালাক-চতুর। মাঝে মাঝে বেতন বাদে জীবনের কাছ থেকে একশ-দুশো টাকা বেশি চেয়ে নেয়। জীবনও তা দিয়ে দেয়। আসলে জীবনও নিজে থেকে এখনো কোনো মেয়ের সঙ্গে কোনো সম্পর্কই তৈরি করে উঠতে পারেনি। যদিও তার কুমারত্ব এখনো অটুট, কিন্তু মেয়েদের শরীরের প্রতি তার আকর্ষণ প্রবল। ফলে তার একটা দোষ তৈরি হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রাতে একা একা সে মোবাইলে রগরগে পর্ণ ভিডিও দেখে মাথা খারাপ করে।

রান্নাঘর থেকে সরস্বতী চা-বিস্কুট নিয়ে ঘরে ঢোকে। টেবিলে চা-বিস্কুটের কাপ-প্লেট রেখেই ফিক করে হেসে সে বলে, আধঘন্টা আগে চা করলাম; আবার গরম কইরা দিলাম। এ্যাতো দেরী ক্যান্ হয়? এ্যাতোক্ষণ কী করেন অইখানে?
জীবন জবাব দেয়না। শুধু হাসে।

সত্যিই, এব্যাপারে জীবনের সমস্যার শেষ নেই। সবখানেই একই সমস্যা। কোনো কোনো সময় আধঘন্টার ব্যাপারটা একঘন্টার কাছাকাছিও হয়ে যায়। একবার তো দিদিমা তাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে জীবনকে বলেই বসে, “বাব্বা এ যে দেখছি সন্তানপ্রসবের সময় থেকেও বেশি সময় লাগে।” আরেকবার মামাতো বোন মিলি বেড়াতে এসে বলেছিল, “আচ্ছা, তোর পেট থেকে কি লোহার শেকল বেরুচ্ছে?”

চা দিয়েও সরস্বতী যায় না, দাঁড়িয়েই থাকে। জীবন জিজ্ঞেস করে, কিছু বলবে?
কোনো ভণিতা না করে সরস্বতী বলে, আমারে এক হাজার টেকা দিতে পারবেন?
এতোদিন একশ-দুশোর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, আজ হাজার টাকার কথা শুনে জীবন একটু অবাক হয়, বলে, কেন?
— না মানে, আমি একটা শাড়ি কিনমু। গ্রামের বিনুবৌদি শহর থেকে আইন্যা শাড়ি বিক্রি করে। একটা সিফন শাড়ি আমার খুউব পছন্দ হইছে। দিবেন আপনে?
পকেটে দু’হাজার টাকার মতো ছিল। থাকলেও এক হাজার টাকা জীবনের কাছে কম নয়। তাই সে বলে, এখন তো দিতে পারব না।
সরস্বতীর মুখটা একটু শুকিয়ে যায়, বলে, শাড়িটা আমার খুউব পছন্দ হইছিল। আমি আপনেরে মাসে মাসে একশ টাকা কইরা ফেরত দিমু।
জীবন প্রথমে ভাবে টাকাটা দিয়েই দেবে। পরে ঠিক করে বেতন পেয়েই দেবে, তাই সে উত্তর দেয়, দেখি। পরে জানাবো।
সরস্বতী রান্নাঘরে চলে যায়। গেলেও মনে একটা খুসখুস চলতে থাকে, ইস এ্যাতো শখের শাড়িটা যদি অন্য কেউ কিনে নেয়! হাজার টাকা দামের শাড়ি যে কোনোদিন পরেনি সে।


গতকাল আচমকা একটা ঝড় হয়ে গেছে। সঙ্গে বজ্রবৃষ্টি। জীবনের আবার ঘুমোতে বেশ দেরি হয়ে গেছিল। কারণ মোবাইলের সেই রগরগে ভিডিও। ঘুম আর আসতেই চাইছিল না অনেকক্ষণ। পরে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল জানে না।
খুব ভোরে দরজায় ঠকঠক আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে যায়। কান পেতে শোনে। আবার ঠকঠক আওয়াজ। সে একটু আশ্চর্য হয়। এতো ভোরে আবার কে! উঠে দরজা খুলতেই সে দেখে একটা ছায়াশরীর হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করেছে। জীবন চমকে ঘরের লাইট অন করতেই দেখে ছায়াশরীরটা সরস্বতী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সরস্বতী মৃদুস্বরে বলে ওঠে, আমারে এখন এক হাজার টেকা দিবেন?

সরস্বতীকে দেখে জীবন প্রথমে বেশ অবাক হয়। কিন্তু সরস্বতীর কথাগুলি কানে যেতেই জীবন অবাক হয়ে দেখে, সামনে এখন আর সরস্বতী নেই। সামনে এখন যেন সানি লিওনির ছায়াশরীর। ছায়াশরীরটাকে তার একেবারে সামনে দেখে তার বেশ মাথা গরম হতে থাকে। তার শরীরটা এক উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে। হাত কাঁপতে থাকে। কাঁপা হাতে এগিয়ে সে সেই ছায়াশরীরের ব্লাউজটা একটানে ছিঁড়ে ফেলে। তারপরই জীবন আবার অবাক হয়ে দেখে, সামনে এখন আর সানি লিওনি নেই। সামনে এখন আবার সরস্বতী। জীবন থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বিস্ময়ে তার চোখ দুটো গোল হয়ে যায়। কোনো নারীর যে এমন রূপ হতে পারে সে কল্পনাও করেনি। জীবনে প্রথমবার সামনাসামনি কোনো নারীর অদ্ভুত এমন উদোম বুক দেখে জীবনের কল্পনা খান খান হয়ে ভেঙে যায় এবং মাথার ভেতরে যে রগরগে ভিডিওর দৃশ্যগুলি ছিলে তা একেবারেই উবে যায়। এক বিরাট ঠোক্কর খেয়ে সে যেন বাস্তবে ফিরে আসে। তার সামনে সরস্বতীর মাংসহীন বুক এখন একদম খোলা। সেই খোলা বুক থেকে সরস্বতীর বুকের পাঁজরের হাড়গুলি ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। দু’পাশে একেবারেই শুকনো দুটো স্তনের চিহ্ন। সে স্তনে কোনো হাতছানি নেই। শুধু চামড়ার এক আস্তরণ। যেন আফ্রিকার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের এক ছবি। জীবন একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়। আফ্রিকার দুর্ভিক্ষের ছবির মতো সরস্বতীর রূপ দেখে সে একটু ভয়ও পায়। তাড়াতাড়ি সে একটা চাদর দিয়ে সরস্বতীর শরীরটাকে ঢাকে। এক হাজার টাকা বের করে দেয়। তারপর বলে, তুমি এখন যাও।

জীবন বেশ বুঝতে পারে জীবন এবং যৌবনের মাঝখানে এই পৃথিবীতে ভেবে দেখার মতো আরো অনেক কিছু আছে।