জরা শবরের কথা – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

জরা শবরের কথা          (ছোটোগল্প)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য            

শালা হারামির বাচ্ছা, বেইমান, ভাগ……কালো বিড়ালটাকে রাগে দুরে ঠেলে দেয় জরা।

নিরাপদ দুরত্ব থেকে বিড়ালটা জুল জুল করে চেয়ে থাকে জরার দিকে। মাপতে চায় জরার মেজাজের ঝাঁঝ। কিছুটা হতচকিতও, এমন অভ্যর্থনা আশা করেনি যেনো।

খানিক আগেই একটা বড়ো মেঠো ইঁদুর ধরে এনে জরার থেকে বেশ কিছুটা দুরে বসে আয়েস করে খাচ্ছিলো। তাই দেখে শুকনো জিভে জল এসেছিল জরার। মেঠো ইঁদুর পুড়িয়ে খায়নি কতো কাল।

পেটের খিদে মাথা তুলে গুঁতো মারে আবার জরাকে। শেষ তিন দিন অনাহারেই কেটেছে জরার। তাই ইঁদুরটাকে পেতে অস্থির হয়ে উঠেছিল। মুখে নানা শব্দ করে। হাত নেড়ে প্রলোভন দেখায় বিড়ালটাকে। কাছে ডাকার চেষ্টা। জরার ফাঁদে পা দেয়নি, ফিরেও তাকায়নি বজ্জাত বিড়ালটা জরার দিকে। মেজাজ সপ্তমে চড়ে। ইচ্ছে হচ্ছিলো মাথায় লাঠির বাড়ি দিয়ে মেরে ফেলে বিড়ালটাকে। শরীরের সেই ক্ষমতা আর কোথায়! শেষমেশ অতি কষ্টে হাতের লাঠিটাই ছুঁড়ে দেয় বিড়ালটার দিকে। লাঠির ভয়ে বিড়ালটা পালালে, আদ খাওয়া ইঁদুরটা পেতো জরা। আগুলে ঝলসে নিলেই চলতো। তেমনটা হয়নি। ঝোঁপের আড়ালে গিয়ে খাওয়া শেষ করে বেড়ালটা এখন এসেছে জরার সঙ্গে পীড়িত করতে। খিস্তি দিয়ে সরিয়ে দেয় জরা।

একটা কালো বিড়াল সর্বক্ষণ জরার পায়ে পায়ে ঘোরে।  থাকতে থাকতেই নখের আঁচড় দেয় জরার গায়ে, পায়ে। যেনো পরখ করে চলে প্রতি মুহূর্তে জরা জীবিত না মৃত। মন ভালো থাকলে বিড়ালটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় জরা। আদর করে, কথা বলে নরম সুরে। চরম গালিগালাজও করে মেজাজ বিগড়ে থাকলে। মনের ব্যথা, যন্ত্রণা, ক্ষোভ, দুঃখের জমে থাকা সমস্ত কথা খিস্তি হয়ে ধেয়ে যায় বিড়ালের দিকে। তাতে জরার মনের রাগ স্তিমিত হয় খানিক। সত্যি কথা বলতে এ পৃথিবীতে তৃতীয় কেউ নেই যে জরার কথা শোনে, দুটি প্রাণী ছাড়া। ওই কালো বিড়াল আর জরা নিজে। সারা দিনের যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতির কথা নিজেকে নয়তো বিড়ালটাকেই বলে জরা।

আজ টানা তিনদিন জল ছাড়া দানা পড়েনি জরার পেটে। বরং সাত সকালেই বেদম প্রহার জুটেছে । তারপর থেকে বসে ঝুপড়ির সামনের চালতা গাছটার নিচে। শরীরে যন্ত্রণা অসহনীয়। এমনিতেই বয়স তিন কুড়ি পৌঁছনোর আগেই বার্ধক্য জড়িয়ে ধরেছে জরাকে। নিজেকে এক বিঘত এগিয়ে বা পিছিয়ে নিয়ে যেতে ঝনঝন করে ওঠে হাঁটু, কোমড়। শরীরের ভার বহনে অক্ষম তারা জানান দেয় প্রতি মুহূর্তে। এইবার কাজে জবাব দিতে সোচ্চার জরার দেহের অঙ্গগুলো। তার উপর চুলোর পোড়া কাঠের বেশ কয়েক ঘা পড়েছে জরার পিঠে, কোমড়ে, ঘাড়ে। যন্ত্রণায় আড়ষ্ট সর্বাঙ্গ। টেনে হেঁচড়ে কোনো রকমে কুন্তীর সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছে নিজেকে। নয়তো ছেলের বউয়ের হাতে মার খেয়ে মরেই যেতো আজ। কুন্তী আগেও মেরেছে তার শ্বশুরকে। তবে এমন নির্দয় ভাবে নয়। দু এক চড় থাপ্পড় দিয়েই ক্ষান্ত থেকেছে। আজ জরার কাণ্ড দেখে নিজেকে সামলাতে পারেনি কুন্তী। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বেদম প্রহার করে।

কুন্তী পোয়াতি। আজ কাল অবস্থা হয়ে রয়েছে। তারপর মাথায় দানা বেঁধেছে নতুন এক দুশ্চিন্তা। নিতু নাকি নতুন করে ঘর পেতেছে অন্য মেয়েমানুষ নিয়ে। স্বামীর এমন কাজ কোন বউই বা মেনে নিতে পারে! কুন্তীও পারেনি। স্বাভাবিক। রাত দিন সেই কথা ভেবে  জরাকে শুনিয়ে গালিগালাজ করে কুন্তী নিতুর উদ্দেশ্যে। শ্বশুর আর স্বামী দুজনের চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে সব সময়। নিতুকে বলে শালা বেজন্মার বাচ্ছা। নিতুর বাপ মা তুলে আরো অনেক কথাই বলে কুন্তী। জরা শোনে চুপ করে। গায়ে লাগলেও বলার কিছুই নেই। ঠিকই বলে কুন্তী। নিতু একটা হারামি। বউ থাকতে অন্য মেয়ে মানুষের রসে মজেছে। লাজলজ্জা নেই শুয়োরের বাচ্ছাটার। পশুরও অধম। জরা বলে, নিতু ওর মায়ের স্বভাব পেয়েছে। নিতুর মা ছিলো পাকা ছিনাল। ঘরে স্বামী থাকতে মাহাতো পাড়ার বাবুদের সঙ্গে ঢলাঢলি করতো খুব। অনেক বাবুকে ঘোল খাইয়েছে নিতুর মা। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা যৌবনের ঝলক ঠিকরে বের হয়ে আসতো। আর তাতেই বেসামাল হতো মাহাতো পাড়ার অনেকেই। শাকপাতা আনতে যাবার অছিলায় পীড়িত করতে যেতো শনিচরি বিলের দিকে। সে নিয়ে নানা কথা শুনেছে জরা লোকমুখে। নিজেও দেখেছে তার বউয়ের নানা কাণ্ড। তবে বউকে শাসন করার সুযোগ জোটেনি জরার।  স্বামী আর ছেলে ফেলে জরার বউ  চলেই গেলো একদিন রাতে। নিতু তখন বছর দুয়েকের বাচ্ছা। মাহাতো পাড়ার এক ছোকরার সঙ্গে মুলুক ছেড়ে পালিয়ে গেলো নিতুর মা। আর ফেরেনি কোনো দিন জরার কাছে। পাড়ায় কান পাতলে সেই পুরনো কেচ্ছার কথা শোনা যেত একসময়। শবর বাউরিদের এমন কেচ্ছা অবশ্য ঘরে ঘরে। শরীর ভাঙিয়ে পয়সা নিতো অনেকেই। নিতুর মায়ের সেই সব কথা জানে কুন্তী। সে নিয়েও নানা কুকথা বলে শশুরকে। সত্যি কথা। শুনে চুপ থাকে জরা। তবে নিতুর ব্যাপারটা আগে আঁচ করতে পারেনি জরা। দিব্যি হাসি মুখেই দিন কাটতো কুন্তীর সঙ্গে।

নিতুকে খাইয়ে মাখিয়ে বড়ো করেছে জরা। কম কষ্ট করতে হয়নি দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে। সে তো আজকের কথা নয়। খাবার তখনোও দুয়ারে আসেনি। সে চিন্তা ছিলো দুর ভবিষ্যতের গর্ভে। শবর, বাউরি এই সমস্ত প্রান্তশায়ী মানুষের বাঁচামরা নিয়ে শহুরে মানুষের ভাবনার সময় ছিলো কম। বছরের দুই তিন মাস কাজ মিলত জঙ্গলের রেশম চাষে। তারপর শুধুই টানাটানি। জঙ্গল চষে ছাতু, কন্দ জোগাড় করে বিক্রি করে এসেছে গিধনির বাজারে। একবেলার খাবার পেতেই হিমশিম খেয়েছে। সে কথা কি মনে রেখেছে নিতু! হারামি, হারামি। পাকা হারামি। বলে জরা।

বছর তিনেক আগে কাজের খোঁজে গ্রাম ছেড়েছিলো নিতু। তারপর বাপের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না প্রায় দু বছর। গেলবার শীতের সময় হাজির হয়। সঙ্গে কুন্তী। বিয়ে করে নিয়ে এসেছে সঙ্গে। বাপ আর বউয়ের সঙ্গে মাস খানেক ছিলো নিতু। তারপর থেকে আবার বেপাত্তা। এদিকে বাচ্ছা বিয়োবে কুন্তী, সে দিকে খেয়াল নেই। কান্নাকাটি করে কুন্তী এ নিয়ে। দিন কয়েক আগে বাউরিদের এক ছেলের কাছে খবর পায় কুন্তী গিধনির কাছে ইঁটের ভাটায় কাজ করে নিতু। সেখানেই অন্য মেয়েমানুষ নিয়ে সংসার পেতেছে। লোক মুখে শোনা কথা। তবে বিশ্বাস হয় জরার। বেজন্মাটা ওই রকমই। এদিকে কুন্তীর শরীরে শরীর বাড়ছে। তার উপর নিতুর ওই কাণ্ড। রাতদিন শুয়ে থাকে কুন্তী। চুলো জ্বালানো তার মনমর্জি। শেষ তিনদিন রান্না চড়ায়নি। এতে আরো বিপদে পড়েছে জরা। অনাহারে মরেই যাবে হয়তো। আর নিজেও যে কিছু জোগাড় করবে তারই বা সামর্থ্য কোথায়। এই আকালের দিনে অন্য রসে ভাসছে নিতু। কপাল!

আজ বছর দুয়েক কাজকর্ম করার সামর্থ হারিয়েছে জরা। পেট ভরাতে হয়েছে পরমুখাপেক্ষী। রাত বিরেতে লুকিয়ে শাল বল্লা কাটতে গিয়ে বনবাবুদের হতে ধরা পড়ে। জেলজরিমানা না হলেও কোমড়ের জোরটুকু কেড়ে নিয়েছে বাবুরা। কোমড়ের উপর থেকে মাথা শরীরে উপরের অংশ বিপদজ্জনক ভাবেই ঝুঁকে থাকে সামনে। উঠতে বসতে মাটি আর নড়তে চড়তে লাঠিই ভরসা। এদিকে ছেলে থাকতেও নেই। না খেয়ে মরবে জরা।

প্রথম প্রথম ভাঙ্গা কোমড় নিয়ে পড়ে থাকতো জরা ঝুপড়িতে। দয়ামায়া দেখিয়েছিল পাড়ার লোক। দুর্দিনে খাবারের স্বাদ টুকু পেতো জরা, সে যতো সামান্যই হোক। সেভাবে আর চলে কয়দিন! এমনিতেই তো পাড়ার সবার অবস্থা নুন আনতে পান্তা ফুরায়। সেখানে রোজ রোজ জরার কথা ভাববার বিলাসিতা কোথায়! এরপর পথ বদলে ছিলো জরা। এর ওর ঝুপড়ির সামনে গিয়ে বসে থাকতো চুপটি করে। কাউকে খেতে দেখলেই বাড়িয়ে দিতো হাত। গলায় করুণ সুর। সে নিয়ে হাসাহাসি করতো লোকে। শবর বাউড়িদের ঝুপড়ির সামনে জরার আগে কোনো ভিখারি দাঁড়ায়নি। তবে প্রথম ভিখারির সম্মানটুকু জুটে ছিলো কয়দিন মাত্র। তারপর থেকে অনাহার হয়েছিলো নিত্যসঙ্গী। পেটের নাড়ি ছিঁড়ে যেতো খিদের জ্বালায়। মাথা ঝিমঝিম করতো। দিনে দিনে না খাওয়াটা কেমন করে অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল জরার সেটা নিজেও টের পায়নি। তারপর…

কুন্তীকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসে নিতু। দুর্দশা কিছুটা ঘোচে জরার। কোনোদিন একবেলা কোনোদিন বা দুবেলা খাবার জুটেছে। ছেলে বউ খেউড় করলেও খাবারের গন্ধে কানে নেয়নি সেসব কথা। এরপর নিতু কেটে পড়লো। শেষ কয় মাস কুন্তী এদিক সেদিক করে খাবার ব্যবস্থা করেছে। কুন্তীর গালমন্দ শুনলেও দিন চলছিলো কোনো রকম। সে সুখেও ছাই দিলো নিতু। নতুন করে ঘর বেঁধেছে। কুন্তীর যতো রাগ এসে পড়েছে জরার উপর। এখন আর ফিরেও দেখেনা শ্বশুরকে।

আজ সাতসকালে সামান্য সজনেপাতা আর গুগলি জোগাড় করেছিলো কুন্তী। সামনেই বসেছিল জরা। সিদ্ধ খাবারের গন্ধে তিনদিনের খিদে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দেহের প্রতিটি কলাকোষে। ওদিকে জরার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে খেতে থাকে কুন্তী। সিদ্ধ শাক আর গুগলি দেখে নিজের লোভ সামলাতে পারিনি জরা। কুন্তীর পাতে হাত রাখে। আগুন জ্বলে ওঠে কুন্তীর মাথায়। চুলোর পোড়া কাঠ নিয়ে বেধড়ক মারে জরাকে।

মেরেই ফেলত আজ। ভ্যাগিস…

যন্ত্রণা কাতর শরীরটা এলিয়ে দেয় জরা চালতা গাছের গায়ে। সামান্য তফাতে শুয়ে রয়েছে বেড়ালটা। কুন্তী দাঁড়িয়ে রয়েছে ঝুপড়ির সামনে। দেখতে পায় জরা। চেয়ে থাকে কুন্তীর দিকে। হাড় জিলজিলে শীর্ণ শরীরে উঁচু পেটটাই চোখে পড়ে শুধু। কুন্তীকে দেখে খানিকক্ষণ। চোখ ফেরায় জরা। দৃষ্টি হেঁটে চলে অন্য ঝুপড়িগুলোর সামনে দিয়ে। সাধু বসে রয়েছে দূরে। মাথায় হাত রেখে ভাবছে কিছু। আজ দু’তিন দিন হলো সাধুর বউটা যায় যায় অবস্থায় রয়েছে। যমে মানুষে দড়ি টানাটানি খেলা চলছে। থাকতে থাকতেই শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে সাধুর বউয়ের। শরীরটা বেঁকে ধনুক হয়ে যায়। ফেনা কাটে মুখে। আর তখনই সাধুর বাচ্ছা ছেলেটা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। কয় দিন ধরে এমনই চলছে। জীবনমৃত্যুর হেঁয়ালি চলছে যেনো। ভালো লাগে না আর জরার। সাধুর বউটা মরলে জরা অন্তত কয়টা দিন খেয়ে বাঁচে। আহা, সরু সরু চিকন চিকন চালের ভাত খেতে পাবে কয়টা দিন। নিচু গলায় যমকে গালিগালাজ করে জরা। ব্যাটার ছেলে যমের চোখে চামড়া নেই! বউটা কষ্ট পাচ্ছে। তুলে নিলেই হয়। একটা কথা কাল থেকেই মনে হয়েছে জরার বেশ কয়বার। আর চরণ শবরের কথাটা কানে বেজেছে। সে বছর দশ পনের আগের কথা…

সেবার পরপর দু বছরের অনাবৃষ্টি। পৃথিবী যেনো বন্ধ্যা হয়ে উঠেছিল। সারা জঙ্গল ঘুরেও কিছুই মেলে না। কারান ছাতু, মার্বেল ছাতু, কুরকুরে ছাতু, মেঠো আলু, কন্দ, কুদরুকি, শাক কিছুই নেই। কিছুই নেই। অমন শনিচরির বিল, সারা বছর টলটলে থাকে জলে, তারও বুক শুকিয়ে কাঠ। নেই নেই আর নেই। শবর আর বাউরিদের পড়ায় বাতাসে নির্মম হাহাকার ভেসে বেড়ায়। এদিকে জঙ্গলে নতুন করে গাছ লাগাবে বলে রেশমচাষও বন্ধ রেখেছিলো বনবাবুরা। কাজ নেই মেয়ে, বউ আর পুরুষদের। তেমন অবস্থায় মাহাতো বাবুরা শবর আর বাউরিদের বেকায়দায় ফেলতে ধারে চাল ডাল দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। সে যে কি শোচনীয় অবস্থা!  প্রকৃতি আর মানুষের নির্মমতায় দিশাহারা সবাই। আচমকা একরাতে চরণের চিৎকার শুনে জেগে ওঠে সকলে। একসঙ্গে তিন জন হার মেনেছে অনাহারের কাছে। চরণের বাপ, মা আর ভাই মরেছে। খবরটা শহরে পৌঁছেছিল কি ভাবে যেনো। তারপর সে কি কাণ্ড! খাবার আর খাবার। শহর থেকে বাবুরা এসে চাল, ডাল, আলু আরো কত কি দিয়ে গেলো। সরু সরু চিকন চিকন চালের ভাত। সকাল রাত্রি দু বেলা। বেশ কয়েক দিন ধরে উৎসব চলেছিলো। মহানন্দে কেটেছিল অনেক কয়টা দিন। চরণ বলেছিলো জরাকে, শবর বাউরি না মরলে শবর বাউরি বাঁচে না। ঠিক কথা, সে কথার সত্যতা টের পেয়েছে জরা বহুবার। জরাদের জন্য খাবার তখনই আসে যখন কেউ না খেয়ে মরে। এই নিয়ে ভেবেছে জরা অনেকবার। শহরের বাবুরা খাবারটা আগেই তো দিতে পারে। তাহলে…

পুরানো কথা ভাবতে থাকে জরা একমনে। আচমকা বমি করার শব্দ শুনে চোখ মেলে সামনে। বমি করছে কুন্তী। তিনদিন পর খাবার পড়েছে খালি পেটে। বমি হয়ে বের হয়ে গেলো সব। আপশোশ হয় জরার। নষ্ট হলো অমন ডুমো ডুমো গুগলিগুলো। দিতে পারতো জরাকে সামান্য। হারামজাদি মেয়ে সবটা একা খেলো। নে, বোঝ এইবার!

অবসন্নতায় দুচোখ বুঝে আসে জরার। জীবনীশক্তি আর অবশিষ্ট নেই। কেমন যেনো শীত শীত লাগে। তৎকালের দুপুরে গায়ে কাঁটা দেয়। তন্দ্রাচ্ছন্নতায় ডুবে যায় জরা। শুনতে পায় কান্নার সুর। মানুষ মরলে মানুষে যেমন কাঁদে ঠিক তেমন কান্না কানে আসে। সাধু শবর কাঁদছে। সাধুর ছেলেটা কাঁদছে। মরেছে, মরেছে তাহলে সাধুর বউ। এইবার শুধু খবরটা শহরে পৌঁছলেই হলো। ছুটে আসবে বাবুরা। উৎসব নামবে পাড়ায়। সরু সরু, চিকন চিকন চালের গরম ভাতের গন্ধ আসে নাকে। আহা, কি শান্তি, কি শান্তি। আনন্দে বিহ্বল। দু মুঠো ভাত কতো দিন পরে খাচ্ছে জরা। সারা জীবনের অনাহারের যন্ত্রণার উপসম হচ্ছে। শবর, বাউরিদের ঘরে ঘরে ঘাবারের ছড়াছড়ি। আর তখনই বিড়ালটার আঁচড়ে স্বপ্ন ভেঙ্গে যায়। ভীষণ বিরক্ত হয় জরা। দুর্বল হাতেই একটা চড় মারে বিড়ালটাকে। সাধুকে দেখতে পায় জরা। শিরীষ গাছের নিজে বসে। ভাবছে কিছু। একটা দুশ্চিন্তা ঘনিয়ে আসে জরার মনে। দিন কাল বদলেছে এখন। শহরের বাবুরা মানবে কি আজও না খেয়ে মানুষ মরে! যদি জরা নিজেই মরে তাহলেও কি বিশ্বাস করবে কেউ? জরার দেহের হাড়পাঁজর গুলো কি অনাহারের ক্ষত বহন করবে? কে জানে। চিন্তা হয় জরার। দু চোখ জ্বালা করে ভীষণ। গাও গরম। জ্বর এসেছে প্রবল।

বেলা আড় হয়ে এলো এবার। পশ্চিমের ওই উঁচু শিরীষ গাছটা দাঁড়িয়ে রয়েছে দুর্ভিক্ষের চেহারা নিয়ে, তারই নিষ্পত্র ডালে ঝুলে রয়েছে দিন শেষের সূর্য। যেনো চলে যাবার আগে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে অনাহারক্লিষ্ট ঝুপড়ি গুলোয়। পুবে মুখ ফেরায় জরা। দূরের জঙ্গলের মাথায় লালচে আলোর আভা। টুকুস সময় পরেই নামবে সন্ধ্যা। আঁধারে তলিয়ে যাবে ঝুপড়িগুলো। আজ সারারাত উৎকর্ণ হয়েই বসে থাকবে জরা। একটা কান্নার শব্দ শুনবে। মানুষ মরলে মানুষ যেমন কাঁদে ঠিক তেমন কান্না। কপালে হাত ঠেকায় জরা। পুড়ে যাচ্ছে শরীর, শরীরের তাপে। চালতা তলা থেকে উঠে আসে। বসে ঝুপড়ির সামনের দাওয়ায়। ঝুপড়ির ভিতরে রয়েছে কুন্তী। আজ শরীর গতিক ভালো নেয় তার। হাঁস ফাঁস করছে সর্বক্ষণ। অন্যদিন একলা বসে গাল পাড়ে নিতুকে। মনের রাগ, দুঃখ, যন্ত্রণা উগরে দেয় আঁধারে। আজ কুন্তীও ক্লান্ত।

নিঃঝুম হয়েছে শবর আর বাউরিদের পাড়া। দূরের জঙ্গলে ডেকে ওঠে রাত জাগা পাখির দল। সে ডাকে সাড়া দিয়ে নিশুতি হয় রাত। আঁধারে গভীর হয় পৃথিবীর ঘুম। দাওয়ায় শুয়ে জরা। বন্ধ হয়ে আসে দু চোখের পাতা। শনিচরি বিলের হওয়া কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়ে যায়। শীতে কুঁকড়ে ওঠে জরা। নিতুকে দেখতে ইচ্ছে হয় খুব। পুরনো দিনের কথা ধেয়ে আসে মনে। সময় ডুব দেয় গভীর রাত্রির বুকে। একটা কান্নার সুর ভেসে আসে বহু দুর থেকে। শুনতে পায় জরা। সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হয় সে সুর। স্মৃতির দোয়ারে এসে দাঁড়ায় অতীত সময়ের এক আনন্দঘন মুহূর্ত। কতকাল আগে এমনি এক রাতের বেলায় শুনেছিলো নবপ্রাণের আগমন ধ্বনি। নিতু এসেছিলো জরার ঘরে সেই রাতে। আজ এই নিরালকে তেমনই কান্নার সুর বেজে ওঠে। দুচোখে জল আসে জরার। কুন্তীকে দেখতে মন চায়। হাজার চেষ্টায় ব্যর্থ হয় জরা দুচোখ মেলতে। মাথা যেনো কয়েক মণ ভারী হয়ে এসেছে। শরীর হয়েছে অবশ। বুকের বাতাস ফুরিয়ে আসছে এবার। আজ সারাদিন ধরে বসেছিল জরা কান্না শুনবে বলে। মানুষ মরলে মানুষে যেমন কাঁদে, তেমন যন্ত্রণার সুর। এ কান্নার সুরে যন্ত্রণার রেশ নেই। মনের ঘনীভূত দুশ্চিন্তা একটা শ্বাসের সঙ্গে বাইরে আসে জরার বুক ফুঁড়ে। শহুরে বাবুরা কি বিশ্বাস করবে আজও মানুষ অনাহারে মরে!

অন্ধকার জমাট ভীষণ। হিমশীতল হয়ে এসেছে দেহ। পড়ে আছে জরা। অফুরান অনাহারের অস্পষ্ট প্রস্তরমূর্তি যেনো। লাঠিটা রয়েছে পাশেই। কালো বিড়ালটা আঁচড় দেয় জরার পায়ে। পরখ করে দেখে জরা জীবিত না মৃত। সদ্যোজাতের কান্নার সুর আঁধার ঠেলে ছড়িয়ে পড়ে শবর আর বাউরিদের পাড়ায়।