ঘুলঘুলি – সদানন্দ সিংহ

ঘুলঘুলি       (ছোটোগল্প)

সদানন্দ সিংহ

সু, তুই কি সত্যিই তাহলে এলি? কতোদিন বাদে এলি! আয়। বস্‌। কী খাবি বল্‌। অবশ্য কীই বা খাওয়াতে পারব তোকে! আমি তো বহুকাল নিরামিষাশী। সেই যখন দশ বছর আগে মা মারা গেলেন তখন থেকে। বাবা তো তার দু’বছর আগেই চলে গেছিলেন। ঠিক আছে, আমি তোকে নিরামিষ ডিশ তৈরি করে খাওয়াব। আমার একান্ত নিজস্ব ডিশ। কচি পালং, কচি ডাঁটা, কচি মূলা, কচি গাজর, কচি আলু – সব কচি শাকসবজি দিয়ে তৈরি হবে। তা তুই কিন্তু সেই পঁচিশ বছর আগের মতোই কচি হয়েই আছিস। এই তো বেশ। চিরযৌবনবতী। আর আমাকে দেখ্‌, বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। চুল-দাড়ি প্রায় সাদা। একা থাকি। বিয়ে করিনি। কোনো ঝুটঝামেলা নেই। কোনোদিন নিজেকে জিজ্ঞেস করিনি, কেমন আছিস? তবে হ্যাঁ, বেঁচে আছি। আমার মতো পৃথিবীর কতো লোকই তো এভাবে বেঁচে আছে। তুই তো দেখছি আগের মতোই অপরূপা। তোকে দেখে আমার যে মাথা ঘুরে যায়। আহা। তোকে দেখলেই ভালবাসতে ইচ্ছে করে রে। আগেও যেমন করতো, এখনও করে। তোর কপালে একটা চুমো খেতে বড্ড ইচ্ছে করে। আর কিছুই না। জানি, এবার তুই ভয় গেছিস। না, না, ভয় নেই। আমার মতো লোকের কাছ থেকে পৃথিবীর কারুর ভয় নেই। তোকে আমি কিছুই করব না রে। দেখিস তুই, তোর কাছ থেকে আমি পাঁচ হাত দূরে দূরে থাকবো। শুধু তোর সঙ্গে কথা বলবো। হাসবো। জানিস, কতোদিন ধরে আমি হাসি নি। হাসতে একদম ইচ্ছে করে না। জানি, পৃথিবীর অনেক লোকই জোর করে হাসে। জোর করেও হাসায়। আমি তো তেমন না। আমার যে কাঁদতেও ইচ্ছে করে না। শেষবার কেঁদেছিলাম সেই পঁচিশ বছর আগে, কেঊ এসে বিয়ে করে যখন তোকে বধূবেশে নিয়ে গেল সেই তখন। তারপর থেকে আর কাঁদিনি। বাবা-মা যখন মারা গেলেন তখনও কাঁদিনি। কী হবে কেঁদে? কান্নার কী কোনো মূল্য আছে যে আমি কাঁদবো? এবার একটা বাড়তি শব্দ বলে ফেললাম! মূল্য! মূল্য আবার কী? মূল্য ব্যাপারটাই তো গোলমেলে। বহুরূপী। তবে মূল্য জিনিসটা আমাকে কুরে কুরে খায়। আমার শিরা-উপশিরায় দৌড়োয়। এসব কথাগুলি তোকে না বললেও হতো। যাক এসব কথা। কতোদিন পরে এসেছিস। আমাদের বাড়িটা কিন্তু আগের মতোই আছে। সেই একতলা বাড়ি। তিনটে ঘর, ওপরে একটা ছাদ। আমি আমার আগের ঘরেই থাকি। দুটো ঘর খালি। ছাদে যাবি? চল্‌ ছাদে। ঐ দেখ্‌ ছাদে। ওখানে চড়ুইপাখির মেলা। দেখ্‌, কতো চড়ুইপাখি। আমি ওদের জন্যে কাঠের বাক্স দিয়ে অনেকগুলি ঘর বানিয়ে দিয়েছি। ঘুলঘুলির মতো এক-একটা দরজা করে দিয়েছি। ওদের বড় কষ্ট রে। ওদের থাকার জায়গা কোথাও নাই রে। এখানে ওরা আনন্দে থাকে। ডিম পাড়ে। আস্তে আস্তে ডিম ফুটে বাচ্চাগুলি বেরুয়। মা-বাবারা বাচ্চাগুলিকে খাইয়ে দেয়। বাচ্চাগুলি একসময় বড় হয়। আমার খুব ভালো লাগে এসব দেখে। প্রতিদিন আমি ওদের খাবার দিই। শুনে হাসি পাচ্ছে? ভাবছিস, যার নিজেরই খাবার ব্যবস্থা নেই, সে পাখিদের খাওয়াচ্ছে? মিথ্যে বলবো না, আমার কোনো আয় সত্যিই নেই এখন। অলীককে জানিস? আমার একমাত্র ছোটভাই। সে বড় শহরে থাকে, ভালো চাকরি করে। সে আমাকে মাসে একবার এসে টাকা দিয়ে যায়। সেই টাকা দিয়েই তো আমি নিজে খাই, পাখিদের খাওয়াই। আজ তোকেও আমার ডিশ খাওয়াবো। এই বাড়িটার আমার ভাগের অংশটাও আমি ভাইকে লিখে দিয়েছি। আমি যখন থাকবো না, এই পাখিদের কী হবে জানি না। পাখিদের থাকার জায়গা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে রে। শেষের সেদিন কী হবে? আমি জানিনা। আয় সু, তোকে এখন আমার ঘর দেখাই। দেখিস, সিঁড়ির রেলিংটা খুব নড়বড়ে। সাবধানে নামিস। দেখ্‌, এই ঘরেই হ্যাঁ এই ঘরেই আমি এখনো থাকি। মেহগনি কাঠের চেয়ারটা ভালো করে মুছে দিচ্ছি। বস্‌ এখানে। টেবিলে, খাটে বইয়ের পাহাড় জমে আছে। সবগুলি বই আমি পড়ে এখনো শেষ করতে পারিনি। জানিনা এ জীবনে শেষ করতে পারবো কিনা। চারিদিকে ধুলো জমে আছে। মাঝে মাঝে আমি ধুলোগুলি পরিষ্কার করি। কিন্তু কোত্থেকে জানি ধুলোগুলি আবার ওড়ে আসে। এই ধুলোরা এখন আমার নিত্যসঙ্গী। জানিস, মাঝে মাঝে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। বাতাসগুলি কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকে। শ্বাস নিতে আমার কষ্ট হয়। আমি ছটফট করতে থাকি। তখন আমি খাট থেকে টেবিল হয়ে মোড়ায় উঠে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। তারপর ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরের আকাশটা দেখি। বাইরের বাতাস দেখি। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিই। ইচ্ছে হয় নীল আকাশে আমি ভেসে বেড়াই। অন্ধকার ঘর থেকে আলোর বন্যা দেখি। তখন আমার বেঁচে থাকার সাধটা বেড়ে যায় অনন্তকাল। স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয়। মনে হয় এই ঘুলঘুলিটাই আমাকে এতোদিন বাঁচিয়ে রেখেছে।

এখানেই লেখা শেষ। অলীক তার দাদার পুরনো ডায়েরিটা উল্টেপাল্টে দেখে। আর ডায়েরিতে অনেকগুলি ছোট ছোট কবিতা আছে। কিন্তু আর কোনো গদ্য নেই।

দাদার শ্রাদ্ধশান্তি চুকে গেছে দুদিন আগেই। আত্মীয়স্বজনরাও চলে গেছেন। একা থাকতো দাদা গ্রামের এই বাড়িতে। ঘরের ভেতর মরে পড়ে রয়েছিল দাদা। শরীরে পচন শুরু হয়েছিল। পাড়াপড়শিরাই অলীককে খবর পাঠিয়েছিল।

সু নামের মেয়েটিকে অলীক চিনতো। সে ছিল দাদার ব্যর্থ প্রেম। পঁচিশ বছর আগে আরেকজনের সঙ্গে বিয়ে করে চলে গেছিল। তারপর এইটুকু জেনেছিল, বিয়ের দু’বছরের মাথায় গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল সু শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে।   

দাদার চড়ুইপাখিগুলির কথা অলীকের মনে হয়। এ ক’দিনের ক্রিয়াকর্মের ভেতর পাখিগুলির প্রতি তার দৃষ্টি দেবার একদম সময় পায়নি। একটা স্টিলের থালায় বেশ কয়েক মুঠো চাল-ডাল রেখে সে ছাদে যায়। অনেক চড়ুইপাখি কিচিরমিচির করে ডাকছে। পাখিগুলির কাছে গিয়ে সে থালাটা ছাদে রাখে। প্রচুর চড়ুই এসে থালার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাখিদের খাওয়ার দৃশ্যটা অলীকের বেশ ভালো লাগে।

কিছুক্ষণ পর অলীক ছাদ থেকে নেমে আসে। দাদার ঘরে যায়। দাদার খাট এখন একদম উলঙ্গ। দাদার বালিশ, বিছানার চাদর, তোষক – সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মেহগনির কাঠের চেয়ারটাও এখন খালি। কিছুদিন আগে এখানেই কি কেউ বসেছিল? কী জানি!

অলীক দাদার খাটের দিকে চায়। ঘরের চারিদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। চেয়ার ছাড়াও আছে একটা টেবিল, বেতের তৈরি একটা মোড়া আর একটা আলনা। সে আলনায় এখনো দাদার কিছু জামা-কাপড় ঝুলে রয়েছে। টেবিলে অনেক বই আর কাগজপত্র। চারিদিক ঘিরে যেন একটা রহস্য-রোমাঞ্চের গন্ধ। এই রহস্য-রোমাঞ্চের জালেই কি দাদা এতোগুলো বছর এখানে আটকে পড়েছিল ? সে জানে না।

সে লক্ষ করে, দাদার ঘরের চারটা ঘুলঘুলির মধ্যে তিনটা ঘুলঘুলি কাগজের বোর্ড দিয়ে বন্ধ করা আছে। টেবিলের ওপরের দিকের ঘুলঘুলিটা কেবল খোলা। সে মোড়াটাকে টেনে টেবিলের ওপর রাখে। পায়ের চপ্পল খুলে একসময় সে খাটের ওপর উঠে দাঁড়ায়। তারপর খাট থেকে টেবিলে গিয়ে মোড়ায় উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর ঘরের ভেতর থেকে ঘুলঘুলি দিয়ে আকাশটা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়। সত্যিই আকাশটা যে কী অদ্ভুত সুন্দর! এতো সুন্দর যে, সে আগে বোঝার চেষ্টাই করেনি!