সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত – লোপামুদ্রা সিংহদেব

সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত

লোপামুদ্রা সিংহদেব

বিশিষ্ট পণ্ডিত ও দার্শনিক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় শ্রী সুশীল গুপ্তের মাধ্যমে। তিনি “কস্তুরী মৃগের আকুলতা নিয়ে উদ্বেল হদয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে এসেছেন, বলেছেন,“আমায় পথের সন্ধান দিন”।
উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন —
“প্রীতি সম্ভাষণ পূব্বর্ক নিবেদন-
আমাকে যখন কেহ পথের কথা জিঞ্জাসা করে তখন মনে মনে হাসি এবং মনে মনে বলি হায় রে আমার কপাল। স্পষ্ট করিয়া পথ দেখিতে পাইলে নিজে বাঁচিয়া যাই অন্যকে পথ দেখাইব কিসের!
শত সহস্র পথের মধ্যে কেবল একটা পথ আছে, যাহা আমার— নানা প্রকার পরখ করিতে করিতে সেইটে বাহির করাই আমার সমস্ত শক্তির পরিনাম। — ইহা বেশ বুঝিয়াছি, এই পথ খোঁজার মধ্যেই জীবনের সকলের চেয়ে বড়ো শিক্ষাটা আছে—যদি খুঁজিতে না হইত তবে আর যাহা পাই নিজেকে পাইতাম না”।
শিলাইদহ থেকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিখানি যে তরুণকে (সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত) লেখা, তাঁর মন তখন বিশ্বজিজ্ঞাসায় পূর্ণ। এই জিজ্ঞাসার আগ্রহ নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে তিনি কবিতায় একটি চিঠি লেখেন। কবিতাটির নাম ‘কবি নারদ’। সেঁজুতি কাব্য গ্রন্থে প্রকাশিত ‘পত্রোত্তর’ কবিতাতে কবি রবীন্দ্রনাথ তারই উত্তর দেন।
কবিগুরুর “গীতাঞ্জলি” পাঠ করে ভাবের আবেগে মথিত হয়ে তিনি কিছু কবিতা লেখেন যা ‘নিবেদন’ নামে প্রকাশিত হয়। এটি তাঁর লেখা প্রথম বই। ‘তত্ত্বকথা’ তাঁর লেখা প্রথম প্রবন্ধের বই। এই বই দুটির কপি তিনি রবীন্দ্রনাথকে পাঠিয়েছিলেন। সুরেন্দ্রনাথের দাশর্নিক চিন্তা ও পড়াশোনা অগ্রসর হছে, তত্ত্বচিন্তায় তিনি রস পাছেন, কিন্তু বিধিবদ্ধ শাস্ত্রালোচনায় তিনি ভীত। এই সময়েই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সুরেন্দ্রনাথকে শান্তিনিকেতনে বক্তৃতা করার জন্য নিমন্ত্রণ করেন। দশর্নশাস্ত্রে নতুন প্রবেশের আনন্দে বিভোর বক্তা আড়াইঘন্টা বক্তৃতা করলেন, যখন খেয়াল হল –“চেয়ে দেখেন শ্রোতা একলা রবীন্দ্রনাথ আর সকলে উঠে গেছেন”।
সুরেন্দ্রনাথ কবিগুরুর লেখা ‘ফাল্গুনী’র সমালোচনা প্রসঙ্গে বলেন “পূবে আমাদের দেশে “ছলিক”বলে একরকম গীতাভিনয় হতো, সেই অভিনয়ে অভিনেতা আপন মনের কোন গূঢ় অভিপ্রায় অভিনয় ও গানের অছিলায় প্রকাশ করত। নাচ ও গান ছিল তার প্রধান অঙ্গ। —- ফাল্গুনীও এক নূতন ছলিক। কেবল পাথর্ক্য এই যে এতে কোন ব্যক্তিগত ইঙ্গিত নেই”।

সুরেন্দ্রনাথ ছোটবেলা থেকেই ছিলেন মেধাবী, ২/৩ বছর বয়সেই ‘রামায়ণ’ আবৃত্তি করার অস্বাভাবিক ক্ষমতা ছিলো তাঁর। সংস্কৃতে অনার্স ও নিস্তারিনী পদক সহ B.A.পাশ করেন। সংস্কৃত ও দশর্নে M.A. পাশ করার পর তিনি চট্টগ্রাম ও রাজশাহী কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরে প্রেসিডেন্সি ও কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও অধ্যাপনা করেছিলেন।
তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯২০ সালে পি.এইচ.ডি (P.H.D), কেম্‌ব্রিজের ডি ফিল (D.Phil) ১৯২২ সালে ও রোম ইউনিভাসির্টির ডি লিট (D.Lit) ১৯৩৯ সালে পেয়েছিলেন। ১৯২১ থেকে ১৯২২ পযর্ন্ত তিনি কেম্‌ব্রিজে পড়েন ও পড়ান। ঐ সময় তিনি বিদেশে পরিচিতির জন্য রবীন্দ্রনাথের সহায়তা পান।
তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা A History of Indian Philosophy (৫ টি খন্ড), বইটি প্রকাশ করেন ম্যাকমিলান। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে বাংলা ও ইংরাজিতে লেখা বইয়ের সংখ্যা বাইশটি। তার মধ্যে পাঁচটি মৌলিক কাব্যগ্রন্থ ও একটি উপন্যাস। চিত্রকলা, অলংকারশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়েও তিনি প্রবন্ধ লেখেন। ১৯৩৬ সালে লন্ডনে ‘আন্তজার্তিক ধমর্সম্মেলনে তিনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর অন্যান্য রচনা –‘A study of Patanjal’, ‘Yoga philosophy in relation to other systems of Indian thought’, ‘A history of Sanskrit literature’, ‘কাব্যবিচার’, ‘সৌন্দযর্তত্ব’, ‘রবি দীপিকা’ প্রভৃতি।
সুরেন্দ্রনাথ তাঁর অসামান্য পাণ্ডিত্য ও বাগ্মিতার দ্বারা ইংরাজি সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন। তিনি সারা জীবন রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে প্রচুর লেখা লিখে গেছেন। তাঁর শেষ বই ‘Rabindranath, the poet and the philosopher’। প্রচারের অভাবে বইটি তেমন পরিচিতি লাভ না করলেও এটি একটি উল্লেখযোগ্য রচনা। তাছাড়া ‘রবীন্দ্র পরিষদ’ স্থাপনা করে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ধারাবাহিক আলোচনার একটা পথ তিনি নিদের্শ করে গেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ইউরোপের হোটেল ‘রেজিনা’তে থাকাকালীন সময়ে সুরেন্দ্রনাথ ও নিমর্লকুমার সিদ্ধান্ত যেতেন তাঁর সাথে দেখা করতে, এই সময়েই কবিগুরুর মনে ‘বিশ্বভারতী’র কল্পনা হয় যা তিনি এই দু’জন বুদ্ধিমান, বিদ্যোৎসাহী  তরুণদের সবিস্তারে বলেন।
সুরেন্দ্রনাথ সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হয়ে আসার পর বিভিন্ন সংস্কৃত পণ্ডিতদের ‘উপাধি’ প্রদান করেন। রবীন্দ্রনাথকেও ‘কবি সাবর্ভৌম’ উপাধি দিয়ে নিজেরা সম্মানিত হন। মানপত্রটির শেষে লেখা ছিলো —
“তোমাকে সম্মান জ্ঞাপনের নিমিত্ত ‘কবি সাবর্ভৌম’এই উপাধি আমরা আহরণ করেছি। তা নিজ নামের অঙ্গরূপে গ্রহণপূবর্ক আমাদের এই প্রচেষ্টাকে সম্যকরূপে ভূষিত কর।
ইতি গুণগৃহ্য
কলিকাতা রাজকীয় সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের
অধ্যক্ষ এবং অধ্যাপক বর্গ।

(১) স্বর্গের কাছাকাছি-শ্রীমতী মৈত্রেয়ী দেবী।
(২) সংসদ বাঙ্গালী চরিতাভিধান-সাহিত্য সংসদ।